উড়ন্ত হেলিকপ্টার থেকে দড়ি বেয়ে এক-এক করে নেমে এল বাইশটি শরীর। পাঁচতলা বাড়ির ছাদে। কুচকুচে কালো পোশাকে ঢাকা প্রতিটি অবয়বের হাতে বিচিত্র বেঁটে আগ্নেয়াস্ত্র। তারও রং চকচকে কালো।
২০০৮-এর ২৮ নভেম্বর। দক্ষিণ মুম্বইয়ে কোলাবার নরিম্যান হাউস। ২৬/১১-র হামলাকারী জঙ্গিদের নির্মূল করতে ‘অপারেশন ব্ল্যাক টর্নেডো’-র অন্তিম লড়াইয়ে নামলেন ন্যাশনাল সিকিওরিটি গার্ড (এনএসজি)-এর কম্যান্ডোরা। টিভির পর্দায় চোখ রেখে সারা দেশ রুদ্ধশ্বাসে দেখল সেই অভিযান। দিনভর ভয়ঙ্কর গুলি-যুদ্ধের পরে নরিম্যান হাউস মুক্ত হল সন্ধের মুখে। কম্যান্ডোদের বীরত্বকে একচুল খাটো না-করে সেনা, আধা সেনার অনেক কর্তা কৃতিত্ব দিলেন তাঁদের হাতের বেঁটে কালো হাতিয়ারটিকেও। বললেন, শত্রুর খুব কাছাকাছি থেকে মুখোমুখি সংঘাতে (পরিভাষায় ক্লোজ কোয়ার্টার্স কমব্যাট, সংক্ষেপে সিকিউসি) বিশেষ ওই স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রের কার্যকারিতা আরও এক বার প্রমাণিত হল।
তার নাম এমপি-ফাইভ। বাস্তবে বিদেশের বহু রোমহর্ষক কম্যান্ডো অপারেশনের সে নেপথ্য নায়ক, কল্পনাতেও থ্রিলারধর্মী বহু উপন্যাসের ছত্রে ছত্রে তার দাদাগিরি! মিনিটে আটশো গুলি ছুঁড়তে সক্ষম ওই জার্মান সাব-মেশিনগান এ বার কলকাতা পুলিশের হাতে আসছে। প্রথম দফায় আসবে ২৫টি, বন্দুকপিছু কয়েকশো রাউন্ড গুলি-সহ। দাম বাবদ মোট ৩৩ লক্ষ টাকা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে পাঠিয়েও দিয়েছে লালবাজার। মানে, এক-একটার দাম পড়ছে এক লাখ তিরিশ হাজারের কিছু বেশি।
আর যে মডেলটি কলকাতা পুলিশ পাচ্ছে, সেটি এমপি ফাইভ-এ থ্রি। সর্বাধিক চালু মডেলগুলোর অন্যতম। ভারতীয় ফৌজের একাংশ, মার্কোস (মেরিন কম্যান্ডোস) বা এনএসজি তো বটেই, ২৬/১১-র অভিজ্ঞতাপ্রসূত মুম্বই পুলিশের বিশেষ জঙ্গিদমন বাহিনী ‘ফোর্স ওয়ান’-ও এর বলে বলীয়ান। মার্কিন মুলুকের স্পেশ্যাল অপারেশন ফোর্স, সিক্রেট সার্ভিস, এফবিআই হস্টেজ রেসকিউ টিম, ব্রিটিশ স্পেশ্যাল ফোর্স এবং আইআরএ-সন্ত্রাসে দীর্ণ উত্তর আয়ার্ল্যান্ডের স্পেশ্যাল পুলিশেরও প্রধান অস্ত্র বলতে এমপি-ফাইভ। এটি প্রথম তৈরি হয় ১৯৬৬-তে। ইউরোপ-লাতিন আমেরিকার বেশ কিছু দেশে বিক্ষিপ্ত সাফল্য অর্জনের পরে ক্লোজ কোয়ার্টার্স কমব্যাটের ময়দানে তার কপালে দুনিয়া কাঁপানো স্বীকৃতি জোটে ১৯৮০-র মে মাসে। এনে দেয় অপারেশন নিমরোড। সেটা কী?
সে বছরের ৩০ এপ্রিল সশস্ত্র ছয় ইরানি-আরব জঙ্গি লন্ডনের দক্ষিণ কেনসিংটনের ইরান দূতাবাসে ঢুকে ২৬ জনকে পণবন্দি করেছিল। টানা পাঁচ দিন দূতাবাস দখলে রেখে ষষ্ঠ দিনে তারা এক বন্দিকে মেরে লাশ ছুড়ে দেয় বাইরে। মার্গারেট থ্যাচারের সরকার আর দেরি না-করে কম্যান্ডো পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। ব্রিটিশ স্পেশ্যাল এয়ার সার্ভিস (স্যাস)-এর জনা পঁয়ত্রিশ কম্যান্ডো মাত্র ১৭ মিনিটের ঝোড়ো অভিযানে পাঁচ জঙ্গিকে খতম করে দূতাবাস মুক্ত করেন। পাকড়াও হয় এক জন। এক পণবন্দিরও প্রাণ যায়।
ওই অভিযানেরই নাম ‘অপারেশন নিমরোড।’ আর তারই সুবাদে জগৎজোড়া খ্যাতি পায় এমপি-ফাইভ। কারণ, স্যাস কম্যান্ডোদের প্রত্যেকের হাতে ছিল ওই অস্ত্র, যা কিনা চূড়ান্ত ঝুঁকিপূর্ণ অভিযানটিকে সফল করতে বড় ভূমিকা নিয়েছিল বলে পরে জানা গিয়েছে। সেই ইস্তক আমেরিকার বিভিন্ন নিরাপত্তাবাহিনীও এমপি-ফাইভের দিকে ঝুঁকেছে। রাজ্য ও কলকাতা পুলিশের আগ্নেয়াস্ত্র-বিশারদেরা জানাচ্ছেন, জঙ্গিদের কাবু করে তাদের কব্জা থেকে নিরীহ মানুষকে উদ্ধারের ক্ষেত্রে বেঁটে হাতিয়ারটির জুড়ি মেলা ভার। বিশেষত দুষ্কৃতীরা যদি কোনও বাড়িতে ঘাঁটি গেড়ে থাকে, কিংবা বিমান হাইজ্যাক করে নামিয়ে আনে, তখন হানাদার কমব্যাট ফোর্সের হাতে এমপি-ফাইভ থাকা আবশ্যিক। এক আইপিএসের কথায়, “এটা আকারে ছোট, ওজনে হাল্কা, গুলি বেরোনোর হারও
বেশি। উপরন্তু দু’শো মিটার পাল্লায় নিখুঁত নিশানা।”
বস্তুত অপারেশন নিমরোডেও এর প্রমাণ মিলেছিল। পণবন্দিদের ভিড়ে মিশে থাকা এক জঙ্গি যখন গ্রেনেড ছুড়তে উদ্যত, সেই অবস্থায় এমপি-ফাইভের বুলেটে তাকে চোখের পলকে ঝাঁঝরা করে দেওয়া গিয়েছিল। আশপাশের কাউকে জখম না-করেই! তবে একে-ফর্টি সেভেনের মারণ ক্ষমতা আরও বেশি, পাল্লাও প্রায় দ্বিগুণ! তা হলে সিকিউসি’তে এমপি-ফাইভ এগিয়ে কেন?
“বহন ও ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্যের বিচারে।” ব্যাখ্যা দেন অফিসারটি। ওঁর বক্তব্য: ক্লোজ কোয়ার্টার্স কমব্যাটে এই সুবিধেটাই সবচেয়ে জরুরি। সাধারণত এমন সব অভিযানে এক জন কম্যান্ডোকে দু’ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র বহন করতে হয় (হাতের বন্দুক ছাড়াও কোমরে পিস্তল)। উপরন্তু ছোরা, গ্রেনেড-ও রাখতে হয়। এমতাবস্থায় এমপি-ফাইভের মতো ছোট অথচ মারণ হাতিয়ার বিশেষ উপযোগী। প্রসঙ্গত, এমপি-ফাইভের তুলনায় কালাশনিকভ এক কেজির বেশি ভারী, লম্বাতেও ফুটখানেক বেশি।
তাই ঝটিকা অপারেশনে কম্যান্ডোদের অতি প্রিয় এই জার্মান বন্দুক। জনপ্রিয়তার জোরে তাবড় কল্প-রোমাঞ্চ লেখকদের কাহিনীতে তার সদম্ভ উপস্থিতি। ফ্রেডেরিক ফরসাইথের উপন্যাসে বেদুইন বেশধারী স্যাস মেজর এমপি-ফাইভ চেয়েও না-পেয়ে বাধ্য হয়ে কালাশনিকভে সজ্জিত হয়। সাদ্দাম হুসেনের গোপন পরমাণু অস্ত্র ধ্বংস করতে প্যারাশু্যটে দুর্গম মরু-পাহাড়িতে নেমে আসা স্যাস-কম্যান্ডোদের হাতে অবশ্য এমপি-ফাইভ থাকে। বিশ্ব-সন্ত্রাসের পটভূমিতে রচিত টম ক্ল্যান্সি বা জ্যাক হিগিন্সের একাধিক থ্রিলারে যাবতীয় হিসেব-নিকেশের ফয়সালা করে দিয়েছে এমপি-ফাইভ থেকে ছুটে আসা বুলেটের ঝাঁক!
অর্থাৎ, প্রকৃতই আন্তর্জাতিক গরিমাসম্পন্ন হাতিয়ার! কলকাতা পুলিশের মতো মূলত আইন-শৃঙ্খলা ও সাধারণ অপরাধ সামলাতে ব্যস্ত বাহিনীর অস্ত্রাগারে যার অভিষেককে ব্যতিক্রমী হিসেবে দেখছেন পুলিশ-কর্তাদের একাংশ। পশ্চিমবঙ্গে অবশ্য এমপি-ফাইভ প্রথম কেনা হয়েছিল বছর পাঁচ-ছয় আগে, তদানীন্তন বাম মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তার তাগিদে। বর্তমান পরিকল্পনা প্রসঙ্গে লালবাজারের এক শীর্ষ কর্তা বলছেন, “প্রধানত কম্যান্ডো ও স্পেশ্যালাইজ্ড অ্যাকশন ফোর্স (স্যাফ)-কে আমরা এমপি-ফাইভ দেব।” কিন্তু একে-৪৭, ইনস্যাস বা এসএলআরের মতো এমপি-ফাইভ তো নিছক টহলদারির অস্ত্র নয়! তা হলে কি শহরে পণবন্দি-পরিস্থিতি তৈরির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে?
লালবাজারের এক শীর্ষ অফিসারের বক্তব্য: ২৬/১১-র পরে যে কোনও পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রতিটি বড় শহরের পুলিশকে তৈরি থাকতে হবে। “তা ছাড়া এমন অস্ত্র হাতে থাকলে আত্মবিশ্বাসও বাড়বে!” —মন্তব্য করেছেন তিনি।