প্রতীক্ষা।— নিজস্ব চিত্র।
সারাদিন অপেক্ষা করেও এক জন সওয়ারি জোটেনি। মনসুর মিঞার মন তাই খারাপ!
শুধু মনসুর নন, তিন-চার বছরে ভিক্টোরিয়া ও ময়দান অঞ্চলে গাড়ির সওয়ারি বেশ কমেছে। বেড়েছে গাড়ির সংখ্যা। ফলে ব্যবসায় ভাটার টান।
ঘোড়ার গাড়ি আজ ছুটির দিনের বিনোদন কিংবা বিয়ের শোভাযাত্রার গাড়ি। ময়দানে যাঁরা ঘোড়ার গাড়িচালকরা মূলত থাকেন খিদিরপুর অঞ্চলে। এঁরা অনেকেই ঘোড়া রাখেন হেস্টিংসের আস্তাবলে।
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে রাস্তা পেরলেই চোখে পড়ে সার দাঁড়ানো ঘোড়ার গাড়ি। ব্যবসায়ীদের মতে, বদলে যাওয়া রুচি আর গাড়ির সংখ্যা বাড়ার জন্যই এই অবস্থা। প্রায় পঁচিশ বছর ধরে এই ব্যবসায় যুক্ত খিদিরপুরের রাজেশ মণ্ডল বলছিলেন, “বছর চারেক আগেও ২৫-৩০টি ঘোড়ার গাড়ি ছিল। এখন ৫০টিরও বেশি। ভাল উপার্জনের আশায় অনেকেই এই ব্যবসায় আসছেন। তবে ঘোড়ার গাড়ি বাড়লেও, সওয়ারি কমায় সকলেরই রোজগার কমেছে। এখন নিয়ম মেনে লাইনে দাঁড়াতে হয়। রবিবার ও অন্যান্য ছুটির দিনে গাড়ির সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। ফলে সওয়ারির প্রতীক্ষায় সারাটা দিন কেটে যায়।”
বছর দু’য়েক হল এই ব্যবসায় এসেছেন রাজু। তিনি বললেন, “ভাল উপার্জনের আশায় এই পেশায় এলেও এখন আফশোস হয়। যা রোজগার হয় তাতে চলে না। তাই বিকল্প জীবিকার কথা ভাবতে হচ্ছে। এখন সওয়ারির তুলনায় ঘোড়ার গাড়ির সংখ্যা বেশি।”
ঘোড়ার গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধির কারণ কী? এক ঘোড়ার গাড়ির চালক শেখ তাজউদ্দিন বললেন, “আগে শীতে ভাল উপার্জন হত। এখন শীতের সময় কমেছে। বদলেছে মানুষের পছন্দও। তাই কমেছে উপার্জন। এখানে মাত্র ২৩টি গাড়ির নম্বর রয়েছে। বাকি গাড়িগুলির কোনও নম্বর নেই। এই নম্বরগুলি আসলে পুরনো ঘোড়ার গাড়ির নম্বর যা নতুন গাড়িতে লাগানো হয়েছে। সাবেক আমলের ঘোড়ার গাড়ি আজ আর দেখা যায় না। এখন দেখা যায় হাল আমলের দু’রকম গাড়ি ‘মহাভারত’ আর ‘কাচগাড়ি’। এই সব গাড়ি তৈরি হয় বারাণসী, কানপুরে।”
৫০ বছর ধরে এই ব্যবসায় যুক্ত তপন পাল বলছিলেন, “আগে দিনে তিন চার হাজার টাকা পর্যন্ত রোজগার হত। এখন সারা দিনে মাত্র কয়েক’শো টাকা রোজগার হয়। তাতে কর্মচারীদের মাইনে, বা ঘোড়ার খরচও জোগাড় হয় না। তার উপর বর্ষার সময় তিন-চার মাস বসে থাকতে হয়। তবে পুজোর বিসর্জন, শোভাযাত্রা কিংবা বিয়ের মরশুমে কিছুটা বাড়তি উপার্জন হয়।”
ময়দানে ঘোড়া নিয়ে ঘুরতে দেখা গেল কয়েক জনকে। তাঁদেরই এক জন জাকির বলছিলেন, “বংশ পরম্পরায় ঘোড়ার গাড়ির ব্যবসা। রোজগার কমায় পরিবারের অন্যান্যরা ঘোড়ার গাড়ির ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। বাচ্চারা ঘোড়ায় চড়তে ভালবাসে। যা রোজগার হয় কোনমতে চলে যায়।”
নাতিকে নিয়ে ঘোড়ার গাড়ির সফর শেষে সুমন্ত্র রায়চৌধুরী বলেন, “এই গাড়ি চড়ার মজাই ছিল অন্য রকম। ভিক্টোরিয়া ও ময়দান অঞ্চলে এই ঘোড়ার গাড়ি চড়ার অভিজ্ঞতা এখন একটা নস্ট্যালজিয়া। তবে বিভিন্ন বিনোদনের মাঝে ঘোড়ার গাড়ির চড়ার আকর্ষণ কমছে।”
ভিক্টোরিয়া ও ময়দান এলাকা ছাড়াও ঘোড়ার গাড়ির দেখা মেলে রাজাবাজার অঞ্চলে। ঘোড়ার গাড়ির ব্যবসায়ী নাজির আহমেদ ও মহম্মদ জিসান জানান, আগের চেয়ে রোজগার কমেছে তাই অনেকেই পেশা পরিবর্তন করেছেন। কেউ বা পাশাপাশি অন্য কাজ করছেন। এখানে ১০-১২টি ঘোড়ার গাড়ি রয়েছে। বেশিরভাগ ঘোড়ার গাড়ি বায়না হয় বিয়ে এবং পুজোর বিসর্জনের শোভাযাত্রায়। অনেকে ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া নেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ও সিনেমার শ্যুটিং-এর জন্য।