খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘ব্লাড ব্যাঙ্কে প্রচুর রক্ত। এখন আর রক্তের কোনও প্রয়োজন নেই।’
অথচ, দিশাহারা মানুষের হাতে ধরা প্ল্যাকার্ড বলছিল, ‘রক্ত চাই’। হন্যে হয়ে চিকিৎসকেরা ফোন ঘুরিয়ে জেনে নিচ্ছিলেন, ব্লাড ব্যাঙ্কে রক্তের সঞ্চয় কতখানি। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটও উপচে পড়ছিল রক্ত চাওয়ার আবেদনে। বৃহস্পতিবার উড়ালপুল দুর্ঘটনার পরে এটাই ছিল বিভিন্ন হাসপাতালের বাস্তব চিত্র।
রক্তদান আন্দোলনের সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁরা জানাচ্ছেন, গত বৃহস্পতিবারের ওই দুর্ঘটনা-পরবর্তী ছবি মোটেই বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। বরং প্রতি বারই গরমের শুরুতে কিংবা ভোটের সময়ে রক্তের আকালের সাক্ষী হয় কলকাতা। কিন্তু কোনও বারই সেই সমস্যা মেটানোর জন্য আগাম প্রস্তুতি থাকে না। এমনকী, আকাল মেটানোর জন্য স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে এলেও বহু সময়েই তাদের শিবির প্রত্যাখান করা হয়।
স্বাস্থ্যকর্তাদের একটি বড় অংশ স্বীকার করেছেন, এই পরিস্থিতিতে সে দিন মুখ্যমন্ত্রীর বিবৃতির পরেই পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে একের পর এক শিবির বাতিল করা হতে থাকে। পরে অবশ্য প্রবল জনমতের চাপে সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটেন তাঁরা। ফের চালু হয় শিবির।
অথচ এ বার ভোটের বাজারে শুরুর দিকে ছবিটা কিছুটা অন্য রকম ছিল। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে আচমকাই খানিকটা তেড়েফুঁড়ে উঠেছিলেন স্বাস্থ্যকর্তারা। স্বাস্থ্য দফতরের তরফে বিভিন্ন ব্লাড ব্যাঙ্কে লিখিত নির্দেশিকা পৌঁছেছিল। তাতে স্পষ্ট বলা হয়েছিল, পূর্ব নির্ধারিত কোনও ক্যাম্প বাতিল করা যাবে না। কাউকে রক্ত দেওয়া সম্ভব না হলে, কোন ব্যাঙ্কে ওই নির্দিষ্ট গ্রুপের রক্ত মজুত, তা নিশ্চিত ভাবে জানাতে হবে। যদিও কলকাতার সমস্ত সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কের কর্তাই স্বীকার করে নিয়েছেন, এটা কোনও সময়েই হয় না। তাঁদের বক্তব্য, একটি ব্লাড ব্যাঙ্কের সঙ্গে অন্য ব্যাঙ্কের কোনও সমন্বয়ই নেই। তাই রাতারাতি এমন নির্দেশিকা পাঠালেই ছবিটা বদলে যাওয়ার কথা নয়।
বস্তুত, নির্দেশিকা পাঠানোর পরেও ছবিটা না বদলানোয় সরকারি কর্তাদের ভূমিকাও জোরালো। গত বৃহস্পতিবারের দুর্ঘটনার পরে রক্তের আকালের আশঙ্কা যখন বড় আকার নেয়, তখনই সিপিএমের কর্মীদের আয়োজন করা রক্তদান শিবিরকে ‘অচ্ছুৎ’ ঘোষণা করেন নির্মল মাজি। নির্মলের সেই আচরণকে মুখ্যমন্ত্রীর সমর্থন পরিস্থিতি আরও সঙ্গিন করে তোলে। ‘সিপিএমের রক্ত’ প্রত্যাখান করতে গিয়ে মুমূর্ষু মানুষকেই আরও বিপদে ফেলেন তাঁরা।
এত কিছুর পরেও রাজ্য রক্ত সঞ্চালন পর্ষদের প্রধান ওঙ্কার সিংহ মিনার দাবি, ‘‘যথেষ্ট রক্ত আছে। তবে যে কোনও সময়ে সমস্যা হতে পারে ধরেই আমরা কিছু ক্ষেত্রে রক্ত নিচ্ছি, আর কিছু ক্ষেত্রে নাম-ঠিকানা নিয়ে রাখছি। প্রয়োজন অনুযায়ী রক্তদাতাদের ়়ডাকা হবে।’’
‘যথেষ্ট’ রক্ত কিন্তু ছিল না। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ব্লাড ব্যাঙ্কের কর্তারা একটা উদাহরণ দিলেন। সে দিনের দুর্ঘটনায় বি নেগেটিভের এক আহত এসেছিলেন। তাঁর প্রবল রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। কিন্তু ওই গ্রুপের যথেষ্ট রক্ত ছিল না। মানুষ স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে এগিয়ে এসে তাঁকে রক্ত না দিলে বাঁচানো যেত না।
এসএসকেএমের ব্লাড ব্যাঙ্কের কর্তারা জানান, তাঁদের দিন আনা দিন খাওয়া অবস্থা। যা রক্ত আছে, তাতে বড়জোর এক-দু’দিন চলবে। নতুন ক্যাম্প হলে ফের ভাঁড়ার ভরবে। এই দুর্ঘটনার পরে প্রতি দিন প্রায় ৬০-৭০ জন করে এসে রক্ত দিয়েছেন। তাতে সঙ্কট মিটেছে। না হলে সমস্যা হত।
বিভিন্ন ব্লাড ব্যাঙ্কের কর্তারাই জানিয়েছেন, ক্যাম্পের সংখ্যা দ্রুত কমে যাচ্ছে। যে ক’টা হচ্ছে, সেখানেও রক্তদাতাদের সংখ্যা কমছে। কারণ, গরম এবং নির্বাচন।
সাধারণ ভাবে কোনও বড় বিপর্যয় না ঘটলে এ রাজ্যে বছরে প্রায় সাড়ে ১২ লক্ষ ইউনিট রক্তের প্রয়োজন হয়। যেহেতু কলকাতায় বড় অস্ত্রোপচারের সংখ্যা অনেক বেশি এবং সমস্ত জেলা থেকেই সঙ্কটাপন্ন রোগীদের এই শহরের হাসপাতালগুলিতে রেফার করা হয়, তাই কলকাতাতেই রক্ত বেশি লাগে। প্রায় আট লক্ষ ইউনিট। সাধারণ সময়ে অর্থাৎ পুজো, ভোট বা গরমের মরসুম বাদে এই চাহিদার ৭০ শতাংশ মেটানো যায়। বাকি ঘাটতিটা, বিশেষত বিরল গ্রুপের রক্তের ক্ষেত্রে কিছু ঘাটতি থেকেই যায়। ভোট, পুজো বা গরমের সময়ে চাহিদা ও জোগানের এই ঘাটতিটা আরও বাড়তে থাকে।
রক্তদান আন্দোলনের কর্মী দীপঙ্কর মিত্র বলেন, ‘‘ছুটির দিনের পরিবর্তে সপ্তাহে কাজের দিনে রক্তদান শিবির করা হোক। তবে সে ক্ষেত্রে বিকেলে শিবির করতে হবে। গ্রীষ্মপ্রধান দেশে বিকেলে রক্তদান শিবির করলে সুবিধা। কিন্তু এই সরকারের আমলে সেটাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তার একটা বড় কারণ সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কগুলি চলে মূলত আংশিক সময়ের কর্মীদের ভরসায়। বিকেলের পরে তাঁদের পাওয়া যায় না। বহু সময়ে কর্মীর অভাবে ছুটির দিনেও বেশি শিবির থাকলে তা বাতিল করা হয়।’’
রক্তের আকাল মেটাতে এই কর্মী সমস্যার সমাধান কি করা যায় না? স্বাস্থ্যকর্তারা কোনও জবাব দেননি।