Kolkata

আমিই জিতব, এই মনের জোরটাই হারতে দেয়নি

এপ্রিলের মাঝামাঝি কয়েক দিন ধরেই শরীরটা দুর্বল লাগছিল। মাঝেমধ্যে মাথার যন্ত্রণাও হচ্ছিল। তবে সেটা যে সংক্রমিত হওয়ার লক্ষণ, তা বুঝিনি

Advertisement

সুশান্ত দাস (কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী)

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ মে ২০২১ ০৬:২২
Share:

প্রতীকী ছবি।

টানা ১৩ দিন সিসিইউয়ে ভর্তি ছিলাম। মাঝের দু’-তিন দিন হুঁশ ছিল না। তখন যমে-মানুষে টানাটানি চলেছে আমায় নিয়ে। তবে সে সময়ে হাসপাতালের বিছানায় উঠে বসার ক্ষমতা না থাকলেও মনের জোরটা কিন্তু হারাইনি। আর সেই মনের জোরকে সম্বল করেই আজ সুস্থ হতে পেরেছি। হারাতে পেরেছি করোনাকে।

Advertisement

রাজ্যে করোনার সংক্রমণ তখন বাড়ছে। তবে তাতে বিশেষ আমল না দিয়ে তখন ট্রেনে করেই বারাসতের কালিকাপুরের বাড়ি থেকে কৃষ্ণনগরে অফিস করছিলাম। বয়স মাত্র ২৯। তাই ধারণা ছিল, সংক্রমিত হলেও হয়তো বাড়াবাড়ি হবে না। তবে বাড়িতে বাবা-মা, দিদি রয়েছেন, তাই যতটা সম্ভব সাবধানে থাকারই চেষ্টা করতাম।

এপ্রিলের মাঝামাঝি কয়েক দিন ধরেই শরীরটা দুর্বল লাগছিল। মাঝেমধ্যে মাথার যন্ত্রণাও হচ্ছিল। তবে সেটা যে সংক্রমিত হওয়ার লক্ষণ, তা বুঝিনি। ১৭ এপ্রিল জ্বর এল। দেরি না করে এক চিকিৎসকের কাছে গেলাম। তিনি ওষুধ দিয়ে বলে দিলেন, জ্বর না কমলে করোনা পরীক্ষা করাতে হবে। কথাটা শুনে এ বার একটু ভয় হল। বাড়ি ফিরেই নিজেকে বাকিদের থেকে আলাদা করে নিলাম। কিন্তু সারা দিনেও জ্বর না কমায় পরের দিনই করানো হল করোনা পরীক্ষা। দু’দিন বাদেই মোবাইলে মেসেজ— রিপোর্ট পজ়িটিভ।

Advertisement

যদিও রিপোর্ট আসার আগে থেকেই শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা ওঠানামা করছিল। সে দিন হঠাৎ অক্সিজেনের মাত্রা নেমে গেল ৯০-এর নীচে। তড়িঘড়ি বাড়িতেই অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা হল। কিন্তু পরের দিনও অবস্থার অবনতি হতে থাকায় বাড়ির লোকেরা আর ঝুঁকি নিলেন না। ২৩ এপ্রিল সকালেই বাড়িতে এল অ্যাম্বুল্যান্স।

এ দিকে আমার সংক্রমিত হওয়ার খবর তখন পাড়ার সকলের মুখে মুখে। পিপিই পরা অ্যাম্বুল্যান্সচালক এবং তাঁর সঙ্গী যখন আমায় গাড়িতে তুলছেন, দেখতে পেলাম দূরে দাঁড়িয়ে অঝোরে কেঁদে চলেছেন মা-বাবা আর দিদি। দেরি না করে অ্যাম্বুল্যান্স চলল এম আর বাঙুর হাসপাতালের দিকে। যেতে যেতে মনের জোর বাড়ানোর চেষ্টা করছিলাম। মা-বাবার চোখে জল— এই দৃশ্যটা তখন বার বার মনে পড়ছে। মনে মনে ভাবলাম, আমায় জিততে হবে। জিততেই হবে!

হাসপাতালে পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গে আমায় ভর্তি করে নিয়ে শুরু হল ওষুধপত্র, অক্সিজেন। কিন্তু তার পরেও অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছিল। শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা ক্রমশ নীচে নামতে নামতে এক সময়ে ৮০-রও নীচে নেমে গেল। অবস্থা বেগতিক দেখে চিকিৎসকেরা আমায় সিসিইউয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন। এর পরে শুরু হল যমে-মানুষের অসম লড়াই! পরের দু’-তিন দিন আমার কোনও হুঁশ ছিল না। কী হয়েছিল, কিছুই জানি না। তবে চিকিৎসকেরা পরে বলেছিলেন, আমার শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা ভয়ঙ্কর ভাবে কমে গিয়েছিল। এমনকি ফুসফুস মারাত্মক ভাবে সংক্রমিত হয়। এ ভাবে টানা ১৩ দিন সিসিইউয়ে থেকেই বেঁচে থাকার লড়াইটা চালিয়ে গিয়েছিলাম। তবে ৫ মে থেকে ধীরে ধীরে অবস্থার উন্নতি হতে শুরু করল। তার তিন দিন পরে শরীরে অক্সিজেনের মাত্রাও ক্রমশ স্বাভাবিক হতে থাকল। ১০ মে চিকিৎসকেরা হাসপাতাল থেকে ছুটি দিলেন আমায়। আপাতত বাড়িতেই।

করোনার সঙ্গে এই লড়াইয়ে আমিই জিতব, এই মনের জোরটাই আমায় হারতে দেয়নি। হারতে দিচ্ছে না আমার মতো হাজার হাজার মানুষকে। বিশ্বাসটা রাখতে হবে নিজের উপরে। সেই বিশ্বাস রাখতে পারলে এক দিন আমরা সকলেই করোনাকে হারাতে পারব। বাঁচতে পারব আগের মতো, প্রাণ খুলে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন