প্রতীকী ছবি।
আপাত ভাবে কিছুরই অভাব নেই সংসারে! কিন্তু সোনারপুরের ফ্ল্যাটে বসে সানফ্রান্সিসকোয় নাতি-নাতনিদের সঙ্গে কথা বলতেও পদে পদে ঠোক্কর খেতে হয়। স্কাইপে বা মেসেঞ্জারে ভিডিও চ্যাটে ঢুকতেও পাশের বাড়ির কলেজ পড়ুয়া ছেলেটি বা দূর সম্পর্কের ভাগ্নের দ্বারস্থ হতে হয় দাশগুপ্ত দম্পতিকে।
বাগুইআটির আশি ছুঁই ছুঁই প্রবীণ নীলাদ্রি গুহ এখনও গাড়ি চালানোর ক্ষমতা রাখেন। কিন্তু হঠাৎ স্ত্রীর শরীর খারাপ হলে মাথা কাজ করে না। কেউ একটা পাশে থাকলে বড় ভাল হত!
শহরের এই প্রবীণ নাগরিকেরা ক্রমশ দলে ভারী হচ্ছেন। কেউ দোকা, কেউ একা! তাঁদের বেশির ভাগের সন্তানেরাই রুজির টানে কাছে বা দূরে প্রবাসী। ঘরে-ঘরে অসহায়তার নানা রং। মা-বাবার হঠাৎ বিপদে সন্তানেরাও অনেক ক্ষেত্রেই সমান অসহায়। কিছু দিন আগে কলকাতার এই বয়স্কদের নিয়ে একটি ম্যারাথন-এর আসরে গিয়ে তাঁর দুশ্চিন্তার কথা বলছিলেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। আজ, শুক্রবার মুক্তি পাচ্ছে এমন একটি বাংলা ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রবাসী পুত্রের চরিত্রে রয়েছেন প্রসেনজিৎ। আজকের ছিটকে যাওয়া, দেশান্তরী ছেলেমেয়ে ও মা-বাবাদের সমস্যা নিয়ে সার্বিক সচেতনতা গড়ে ওঠা উচিত বলে মনে করেন তিনি। ‘‘বয়স্ক মা-বাবার হাতটা ধরতে পারলেই হয়তো সব থেকে ভাল হত, কিন্তু যাঁদের সে সুযোগ হচ্ছে না, সেই অসহায় মা-বাবাদের জন্য আরও বেশি সামাজিক উদ্যোগ দরকার।’’— বলছিলেন প্রসেনজিৎ।
সম্প্রতি বালিতে এক বৃদ্ধার ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে দেখা গেল, অন্তত মাসখানেক আগে মারা গিয়ে পচা-গলা কঙ্কাল হয়ে তিনি পড়ে আছেন। ওঁর প্রবাসী ভাইপো মাসখানেক ধরে পিসির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না।
বার্ধক্যবিজ্ঞান বিশারদ (জেরেন্টোলজিস্ট) ইন্দ্রাণী চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘শুধু পশ্চিমবঙ্গেই ৭৫ লক্ষ ষাটোর্ধ্ব নাগরিক রয়েছেন। তাঁদের অর্ধেকই একা, অশক্ত। একটা বড় অংশ অর্থনৈতিক ভাবেও কমজোর। সবার জন্য সংবেদনশীল, দক্ষ বৃদ্ধাশ্রমও মিলবে না।’’ জেরেন্টোলজিস্টদের মতে, চিকিৎসাবিজ্ঞানের দাক্ষিণ্যে মানুষের আয়ু বাড়লেও জীবনের মান বাড়েনি। দীর্ঘ আয়ুর সঙ্গে শারীরিক-মানসিক ভোগান্তিও অনেকের রোজনামচা। ‘প্রণাম’ বলে একটি উদ্যোগের মাধ্যমে কলকাতা পুলিশ এই প্রবীণদের পাশে দাঁড়ানোর কিছুটা চেষ্টা করে। এক পুলিশকর্তার কথায়, ‘‘হঠাৎ বিপদ-আপদ ছাড়াও বয়স্কদের আকুতি একটু সঙ্গ! বছরভর নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পুজোয় ঠাকুর দেখায় আমরা ওঁদের সঙ্গে রাখতে চাই।’’ কিছু দিন আগে বালিগঞ্জের বৃদ্ধা মুকুল লাহিড়ীর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের বিপদে পুলিশই ছিল মুশকিল আসান। ভবানীপুরের স্বামী-সন্তানহীন কাজল ঘোষ ‘ক্রিসমাস ইভ’-এ রবীন্দ্রসঙ্গীতের একটি অনুষ্ঠানের টিকিট খুঁজছিলেন। ‘প্রণাম’-এর ছেলেরাই বাড়ি গিয়ে বৃদ্ধার আবদার মিটিয়েছেন।
বছর শেষের এই ছুটির সময়টা মা-বাবাকে দেখতে এসে তাঁদের জন্য নানা উদ্বেগ ছুঁয়ে যাচ্ছে প্রবাসী ছেলেমেয়েদের। তিন দশক আগে ‘পূর্ব পশ্চিম’ উপন্যাসেও দেশে পড়ে থাকা বৃদ্ধ মা-বাবার বিপন্নতায় প্রবাসী ছেলের অসহায়তার কথা তুলে ধরেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। এই ২০১৭-র বাংলা ছবির পটভূমি জুড়েও একই রকম অসহায়তা মিশে আছে বলে অনেকেই টের পাচ্ছেন।