শব্দে জব্দ নগরজীবন

বিধি উড়িয়েই মহানগরের হর্ন-বিলাস, ‘বধির’ পুলিশ

খাস এসএসকেএম হাসপাতালের ফটকের সামনের দৃশ্য যেন প্রতীক। পুরসভার একটা ফাটা পোস্টারের নীচে ঢাকা পড়েছে, ‘নো হর্ন’ চিহ্ন। সামনেই বিকট হর্ন বাজিয়ে হু-হু করে ছুটছে দামাল বাইক। হাসপাতালে ঢোকার মুখে রোগীসুদ্ধ গাড়িও তাতে ভ্যাবাচাকা। মঙ্গলবার ভরদুপুরের কলকাতাতেই এ দৃশ্য দেখা গেল। ট্রাফিক পুলিশের হিসেবে, অফিসটাইমের তুলনায় দুপুরে কম গাড়ি নামে।

Advertisement

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০১৫ ০৪:১৯
Share:

খাস এসএসকেএম হাসপাতালের ফটকের সামনের দৃশ্য যেন প্রতীক।
পুরসভার একটা ফাটা পোস্টারের নীচে ঢাকা পড়েছে, ‘নো হর্ন’ চিহ্ন। সামনেই বিকট হর্ন বাজিয়ে হু-হু করে ছুটছে দামাল বাইক। হাসপাতালে ঢোকার মুখে রোগীসুদ্ধ গাড়িও তাতে ভ্যাবাচাকা। মঙ্গলবার ভরদুপুরের কলকাতাতেই এ দৃশ্য দেখা গেল।
ট্রাফিক পুলিশের হিসেবে, অফিসটাইমের তুলনায় দুপুরে কম গাড়ি নামে। তাতেই হাসপাতালের সামনে যা দেখা গেল, তাতে এ শহরে ‘নো হর্ন’-অঞ্চলের অস্তিত্ব নিয়েই প্রশ্ন উঠবে। সামনের মোড়ে সিগন্যালের লাল আলোর নিষেধ দেখামাত্র পিছনে মোটরবাইক সওয়ারিদের উসখুস শুরু হয়ে গেল। সামনে দাঁড়ানো ট্যাক্সির ‘সাইড’ দিয়ে কোনও মতে ফাঁকতালে গলার প্রতিযোগিতা জমজমাট। হর্ন বাজানো তারই অঙ্গ। হাসপাতালের সামনের রাজপথে হর্ন বাজানো নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করা থাকলেও ওই সব গাড়ির তাতে হেলদোল নেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভরদুপুরেও শব্দে কানে তালা লাগার জোগাড়!

Advertisement

‘সাইলেন্ট জোনে’ কেন বাজালেন?

মোটরবাইক আরোহীকে প্রশ্ন করতেই পাল্টা তর্জন। ‘দেখছেন না, ওষুধ নিয়ে যাচ্ছি! অনেক তাড়া’—বলতে বলতে সিগন্যাল সবুজ হতেই নিমেষে ধাঁ। শব্দের এই উৎসবে কোনও পুলিশ চোখে পড়ল না।

Advertisement

এনআরএস হাসপাতালের দৃশ্যটা আরও জব্বর। সামনেই ট্রাফিক সিগন্যালের গুমটি। দু’জন কনস্টেবল বসে। শব্দ-বিধি ভাঙলে কেস লেখেন তো? অবাক পুলিশকর্মী বললেন, ‘‘হর্ন বাজালে ধরব কেন? সবাই তো বাজাচ্ছে!’’ মুখরিত কলকাতার হর্ন, ট্রামের ঘড়ঘড়ের মধ্যে তাঁদের সঙ্গে কথাও বলতে হচ্ছিল গলা উঁচিয়ে।

এক পুলিশকর্মী বলেন, ‘‘কেউ সিগন্যাল ভাঙলে তাঁদের নাম নোটবুকে টুকে রাখি বটে, ফাইনের সমনও পাঠনো হয়, কিন্তু হর্ন বাজানো নিয়ে এ সব হয়-টয় না। উপরমহল থেকে কিছু বলেনি!’ সংশ্লিষ্ট শিয়ালদহ ট্রাফিক গার্ডের এক অফিসার অবশ্য পরে দাবি করেন, হাসপাতালের সামনে হর্ন বাজানোর জন্যও তাঁরা নিয়মিত কেস দেন। তবু সেখানে কর্তব্যরত কনস্টেবলদের দৃষ্টিভঙ্গিই বলছে, হর্ন বাজানো নিয়ে পুলিশের নিচুতলায় জোরালো বার্তা পৌঁছয়নি।

অথচ, শব্দদূষণের ফলে তৃতীয় বিশ্বে বধিরতার মতো সমস্যা বেড়েই চলেছে। কয়েক বছর আগে তৎকালীন এক প্রধান বিচারপতি তাঁর বাসভবনের কাছে ট্রামের শব্দে বিরক্ত হয়ে বাড়ি বদলাতে চেয়েছিলেন। এই নাগরিক কোলাহলে পর্যন্ত কলকাতার গাড়ির হর্নের আলাদা মহিমা।

এ যুগে রাজপথে শব্দের মাত্রা যে কোনও সভ্য শহরের ভাবমূর্তিরও অন্যতম স্মারক। ইদানীং বিদেশে ঢের বেশি যান বাঙালিরা। বিলেত-আমেরিকার রাস্তায় গাড়িচালকদের নিঃশব্দ সহিষ্ণুতায় অনেক ‘ক্যালকাটান’ই তাজ্জব বনেছেন। কলকাতার সঙ্গে তুলনাটাও বিঁধছে তাঁদের। সদ্য ব্যাঙ্কক ঘুরে আসা চেতলার রবীন বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন বলছিলেন, ‘‘লন্ডনেও দেখেছি, কিন্তু ব্যাঙ্কককে দেখে আরও বেশি অবাক লাগছে। রাস্তায় অহেতুক হর্নের টুঁ শব্দটি নেই। আমরা কেন এমন হতে পারি না?’’ আর নিউ ইয়র্ক প্রবাসী শকুন্তলা ভাদুড়ীর অভিজ্ঞতা, ম্যানহাটনের ব্যস্ত সময়েও হর্ন বাজে বৈকী! তবে অকারণে নয়। ‘‘এখানে (নিউ ইয়র্ক) পিছনে কেউ হর্ন বাজালে লজ্জায় পড়তে হয়। সাধারণত, কেউ গাড়ি চালাতে গিয়ে কোনও ভুল করলে পিছনের চালক হর্ন বাজিয়ে সতর্ক করেন। কলকাতার মতো ওভারটেক করার মতলবে হর্নে কান ঝালাপালা করেন না!’’—বলছেন তিনি।

নিউ ইয়র্কে গাড়ি চালালেও কলকাতার ট্রাফিকে গাড়ি চালানোর সাহস নেই শকুন্তলার। বললেন, ‘‘কলকাতায় লোকের খিটখিটে মেজাজই বোধহয় ঘন ঘন হর্ন বাজানোর কারণ।’’ লালবাজারের ট্রাফিক কর্তারাও মানুষের সচেতনতার খামতিকে এ শহরের হর্ন-বিলাসের কারণ বলে দাবি করছেন। সেই সঙ্গে অবশ্য কলকাতার সরু, ঘিঞ্জি রাস্তা, এত ভিড়ও মেজাজ খিটখিটে করার উপাদান বলে তাঁরা মানছেন। হট্টগোলে কে হর্ন বাজাল, ধরাও মুশকিল। পুলিশের মতে, পথচারীদের সচেতনতার অভাবেও চালক কখনও কখনও হর্ন বাজাতে বাধ্য হন। সেটাই ক্রমশ অভ্যাস হয়ে যায়।

চালকদের এই অসুবিধায় মানুষের ভোগান্তির ছবিটা পাল্টাচ্ছে না। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনেও দেখা গেল, ক’মাসের বাচ্চার কান রুমাল দিয়ে চেপে রাস্তা পেরোচ্ছেন মা-বাবা। তিন দশকের বেশি কলকাতায় মালিকের গাড়ি চালাচ্ছেন প্রদীপ গুহ। তাঁর দাবি, ‘‘বাস-ট্যাক্সি-অটোই তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে বেশি-বেশি হর্ন বাজায়। তবে দেরি হয়ে গেলে টেনশনে আমিও হর্ন বাজিয়ে ফেলি।’’

শহরে শব্দদূষণের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে একদা হাইকোর্টের বিশেষ অফিসার নিযুক্ত হয়েছিলেন আইনজীবী গীতানাথ গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘সামান্য জরিমানায় কি আর লোকে হর্ন বাজানো বন্ধ করবে! আসল কথা, পুলিশের কাছে সমস্যটার গুরুত্ব নেই বললেই চলে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন