চিকিৎসার কাগজপত্র দেখা সত্ত্বেও ‘ভুল করে’ জলাতঙ্কের একই ইঞ্জেকশন দু’বার দেওয়ার অভিযোগ উঠল সল্টলেকের এক বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছেন। যদিও এই ইঞ্জেকশন দু’বার দেওয়ার ফলে ওই তরুণীর শরীরে জলাতঙ্কের মূল প্রতিষেধকটি কতটা কাজ করবে, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞেরা। তাঁদের মতে, জলাতঙ্ক এমনই একটা অসুখ, যা দ্বিতীয় বার চিকিৎসার কোনও সুযোগই দেয় না। এই পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের ‘ভুল’ তরুণীর জীবনে কতটা গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে, সে নিয়ে উদ্বিগ্ন তাঁরা অনেকেই।
কুকুরের কামড়ের ক্ষত যদি বেশি গভীর (থার্ড ডিগ্রি বাইট) হয়, সে ক্ষেত্রে প্রতিষেধকের পাশাপাশি কামড়ের জায়গায় ইমিউনোগ্লোবিউলিন দেওয়াটাই নিয়ম। উত্তর কলকাতার বাসিন্দা, ১৮ বছরের স্নেহা সাউয়ের মুখের কয়েক জায়গায় কুকুরে কামড়ানোর পরে পরিবারের লোকেরা তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন বেলেঘাটার আইডি হাসপাতালে। সেখানে প্রতিষেধকের প্রথম ডোজের পাশাপাশি তাঁর মুখে ইমিউনোগ্লোবিউলিন ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়। এর কিছু পরেই তাঁর সারা শরীরে র্যাশ বেরোতে শুরু করে। ভয় পেয়ে বাড়ির লোকেরা আইডি হাসপাতাল থেকে তাঁকে নিয়ে সল্টলেকের ওই হাসপাতালে ভর্তি করেন। অভিযোগ, আইডি-র সমস্ত কাগজপত্র দেখার পরেও সেখানকার চিকিৎসেকরা তাঁকে ফের ইমিউনোগ্লোবিউলিন ইঞ্জেকশন দেন। শুধু তা-ই নয়, তাঁর অবস্থা গুরুতর বলে জানিয়ে তাঁকে ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিটে ভর্তিও করে নেন।
স্নেহার দাদা স্নেহাশিস সাউ জানান, হাসপাতাল থেকে এ কথা বলায় তাঁরা সকলেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। কিন্তু তার পরে কাগজপত্র খুঁটিয়ে দেখে জানতে পারেন, স্নেহাকে একই ইঞ্জেকশন দু’বার দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘পরিচিত কয়েক জন চিকিৎসকের কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাওয়ায় তাঁরা বলেন, এর ফল মারাত্মক হতে পারে। আমরা হাসপাতালের ডাক্তারদের সরাসরি বিষয়টি জি়জ্ঞাসা করায় ওঁরা ফের আইডি-র কাগজপত্র দেখেন এবং স্বীকার করেন, ভুল হয়ে গিয়েছে। এমনকী আইসিইউ-এ রাখার মতো পরিস্থিতি যে ছিল না, সেটাও মেনে নেন ওঁরা।’’ এর পরেই হাসপাতাল থেকে স্নেহাকে ছাড়িয়ে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং স্বাস্থ্য ভবনের কাছে লিখিত অভিযোগও দায়ের করা হয় স্নেহার পরিবারের তরফে।
কলম্বিয়া এশিয়া হাসপাতালের তরফে অরিন্দম বন্দ্যোপাধ্যায় দু’বার ইমিউনোগ্লোবিউলিন দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছেন। তবে তাঁর দাবি, আইডি-র কাগজপত্র বাড়ির তরফে আগে তাঁদের দেখানো হয়নি। অরিন্দমবাবু বলেন, ‘‘আইডি-তে ঘোড়ার শরীর থেকে তৈরি ইমিউনোগ্লোবিউলিন দেওয়া হয়েছিল। তাতে ওঁর অ্যালার্জি শুরু হয়। অ্যালার্জি কখনও কখনও প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে। তাই আমরা ওঁকে মানুষের শরীর থেকে তৈরি ইমিউনোগ্লোবিউলিন দিই। এতে তেমন কোনও ক্ষতির ভয় নেই।’’ ইমিউনোগ্লোবিউলিন বাবদ যে ১৮ হাজার টাকা স্নেহার পরিবারের কাছে নেওয়া হয়েছিল, সেটাও ফেরত দিয়ে দেন তাঁরা।
তবে অরিন্দমবাবু ‘তেমন কোনও বিপদের ঝুঁকি নেই’ বলে জানালেও ‘অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোল অব রেবিস ইন ইন্ডিয়া’র সহ সভাপতি সুমিত পোদ্দার দাবি করেছেন, ঝুঁকি যথেষ্টই আছে। তিনি জানান, জলাতঙ্কের প্রতিষেধক হল অ্যান্টিজেন। আর ইমিউনোগ্লোবিউলিন হল অ্যান্টিবডি। অ্যান্টিবডি শরীরে বেশি প্রবেশ করলে তা অ্যান্টিজেনের কর্মক্ষমতা কমিয়ে দেয়। সুমিতবাবু বলেন, ‘‘জলাতঙ্কের প্রতিষেধক শরীরে প্রবেশের পরে কাজ শুরু করে সাত দিন পর থেকে। ১৪ দিনের মাথায় সেই কাজটা সম্পূর্ণ হয়। এই কারণেই ভাইরাসটিকে তৎক্ষণাৎ ঠেকানোর জন্য ইমিউনোগ্লোবিউলিন দেওয়াই নিয়ম। কিন্তু অতিরিক্ত ইমিউনোগ্লোবিউলিন, অর্থাৎ অ্যান্টিবডি শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে, সেই কারণেই ওই তরুণী এখন কিছুটা অসুরক্ষিত হয়ে পড়লেন। জলাতঙ্কের মতো মারণ অসুখের ক্ষেত্রে আরও অনেক সাবধানী হওয়া জরুরি।’’