উৎসব: নির্মল মাজির জন্মদিন পালন। রয়েছেন উচ্ছল ভদ্র (বাঁ দিকে)। শনিবার, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী
হাসপাতাল চত্বরের একটি ঘরে ভিড় আর ব্যস্ততা চোখে পড়ার মতো। বেলা একটা থেকেই হই-হই করে প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে। কেউ স্বাস্থ্য ভবনের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক মাঝপথে ছেড়ে এসেছেন, আবার কেউ রোগী দেখা বাদ দিয়ে ফুলের ডালি নিয়ে হাজির হয়েছেন। ফুল, কেক, রঙিন কাগজ, মোমবাতিতে সেজে উঠেছে হাসপাতালের ঘর। কারণ ‘দাদা’-র জন্মদিন!
শনিবার কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মাদার অ্যান্ড চাইল্ড কেয়ার হাবের পিছনের ভবনে রমরমিয়ে পালিত হল ওই হাসপাতালের রোগীকল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান ও রাজ্যের শাসক দলের চিকিৎসক সংগঠন ‘প্রোগ্রেসিভ ডক্টর্স অ্যাসোসিয়েশন’ (পিডিএ)-এর নেতা-চিকিৎসক নির্মল মাজির জন্মদিন। সেই অনুষ্ঠানে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ উচ্ছল ভদ্র, সহকারী সুপার-সহ উপস্থিত ছিলেন একাধিক বিভাগের প্রধান ও নার্সেরা। এ ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন আরজিকর, এনআরএস, সাগর দত্ত-সহ একাধিক মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা।
হাসপাতালেরই একটি ঘরে শাসক দলের চিকিৎসক সংগঠনের কাজ চলে। এ দিন সেখানেই জন্মদিনের ‘উৎসব’ পালন করা হয়। বেলা তিনটে নাগাদ নির্মলবাবু হাসপাতাল চত্বরে প্রবেশ করার পরেই উৎসব শুরু হয়। নীল পাঞ্জাবি পরা নির্মলবাবুর সামনে সার দিয়ে দাঁড়ান বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে আসা চিকিৎসক ও নার্সেরা। একের পর এক হাসপাতালের নাম ঘোষণা করা হয়। এগিয়ে আসেন সেই হাসপাতালের প্রতিনিধিরা। কেউ নির্মলবাবুর হাতে তুলে দেন ফুলের ডালি, আবার কেউ তুলে দেন চকোলেট। তত ক্ষণে জন্মদিনের দু’টি কেক টেবিলে সাজানো হয়ে গিয়েছে। তবে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ উপস্থিত না হলে নির্মলবাবু কেক কাটতে নারাজ। তাই মোমবাতি জ্বালিয়ে শুরু হয় অপেক্ষা।
সওয়া তিনটে নাগাদ সরকারি গাড়িতে চড়ে উৎসব কক্ষের সামনে হাজির হন উচ্ছলবাবু। ‘দাদা’-কে আলিঙ্গন করেই ক্ষমা চেয়ে নেন তিনি। বলেন, ছোট ভাইয়ের দেরি হওয়ায় নিশ্চয়ই দাদা রেগে যাবেন না। তার পরেই শুরু হয় কেক কেটে জন্মদিনের উৎসব পালন। উপস্থিত সব ‘ভাই-বোনদের’ শিঙাড়া আর মিষ্টি খাওয়ানো হয়।
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, এ দিন হাসপাতালের সমস্ত বিভাগের প্রধানদের নিয়ে বৈঠকের বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিলেন অধ্যক্ষ। কিন্তু অধ্যক্ষের ঘরে যাওয়ার পরে তাঁদের সঙ্গে হাসপাতালের কোনও সমস্যা কিংবা পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করা হয়নি। অধ্যক্ষ বিভাগীয় প্রধানদের জানান, নির্মলবাবুর জন্মদিনে সবাইকে উপস্থিত থাকতে হবে। কেন ওই বৈঠক ডাকা হয়েছিল, তা নিয়েও কোনও স্পষ্ট উত্তর পাননি চিকিৎসকেরা।
এ দিনের ঘটনায় চিকিৎসক মহলের একাংশ প্রশ্ন তুলছেন, সরকারি হাসপাতালের ভিতরে এ ভাবে কোনও রাজনৈতিক নেতার জন্মদিন কি পালন করা যায়? এক চিকিৎসকের তির্যক মন্তব্য, ‘‘এত দিন বিধানচন্দ্র রায়ের জন্মদিন পালন করতাম। এখন নির্মলবাবুর করছি। ভেবে দুঃখ হয় যে বিধানচন্দ্র রায় আর নির্মলবাবুকে আমরা এক সারিতে নিয়ে এলাম।’’ সরকারি পদে থাকা হাসপাতালের শীর্ষকর্তারা
কী ভাবে কাজের সময়ে এক রাজনৈতিক নেতার জন্মদিনের উৎসবে সামিল হলেন, সে নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। আর এক শিক্ষক-চিকিৎসকের কথায়, ‘‘সরকারি কলেজে চাকরি করি। এত দিন জানতাম, ডাক্তারি প়ড়ানো ও রোগী দেখাই আমাদের কাজ। এখন জানলাম হাসপাতালের ‘রাজা’র জন্মদিনে প্রজার মতো লাইনেও দাঁড়াতে হবে। অধ্যক্ষও হাতজোড় করে শামিল হবেন।’’
তবে, যাঁকে ঘিরে এত আয়োজন, সেই নির্মলবাবু অবশ্য বলেন, ‘‘কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষই শুধু নন, স্বাস্থ্য দফতরের বিশেষ সচিব, অতিরিক্ত অধিকর্তা স্তরের সমস্ত কর্তাই এ দিনের অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন। সব মিলিয়ে প্রায় ৩০০ জন এসেছিলেন।’’ তবে, নির্মলবাবু দাবি করেছেন, তিনি জন্মদিনের উৎসব সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। শনিবার তাঁর উপোস, তাই কেক কাটলেও কিছু খাননি।