মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন মা। শরীরের অনেকটাই পুড়ে গিয়েছে। কিন্তু প্রাণ বাঁচলেও মনের ক্ষত সারবে কি?
গত দু’দিন ধরে এ প্রশ্ন তাড়া করে বেড়াচ্ছে অনেককেই। কেন না, সেই মাকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে নিজেরই সন্তানের বিরুদ্ধে। পুলিশ জানিয়েছে, সন্তানকে নিয়েই নিউ টাউন এলাকায় আলাদা সংসার ওই মহিলার। স্বামীর সঙ্গে থাকেন না। সোমবার রাতে সেখানেই ঘটে দুর্ঘটনা। অভিযোগ, দামি মোবাইল ও মোটরবাইক দিতে না চাওয়ায় নিজের মাকেই পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করেছে কিশোর ছেলে। নিউ টাউন থানার পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, মহিলার একটি পোশাকের দোকান রয়েছে। শুধু এক দিনের অশান্তি নয়, মাঝেমধ্যেই নানা জিনিসের জন্য চাহিদা প্রকাশ করত অভিযুক্ত সেই কিশোর। মা চাহিদাপূরণ না করতে পারলেই শুরু হত অশান্তি।
এটি কি নিছকই একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা? নাকি মাঝেমধ্যেই এমন একাধিক ঘটনার উদাহরণ দেখা যাচ্ছে সমাজের নানা স্তরে? সাধারণ নাগরিক থেকে সমাজতাত্ত্বিক-মনোবিদ, এই ঘটনায় চিন্তা প্রকাশ করেছেন সকলেই। কারও ভাবনা পরিবারিক সমীকরণ নিয়ে তো কেউ চিন্তিত কমবয়সি মনে বাজার-অর্থনীতির প্রভাব নিয়ে। সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অভিজিৎ মিত্রের যেমন বক্তব্য, মোবাইল, বাইকের মতো সামগ্রী এখন আধুনিকতার আইকন। এই অসুখে আক্রান্ত শুধু ওই কিশোর নয়, গোটা সমাজই। জীবনের মূল্য যেন কমে যাচ্ছে সকলের কাছেই। প্রতি দিনের চলার পথে মায়া-মমতা, আবেগ ক্রমশ কমছে। চাহিদাপূরণ না হলেই বাড়ছে হিংসা। পরিবারের ভূমিকাও রয়েছে। সমাজ কোন পথে চলেছে, নিউ টাউনের এই ঘটনা আরও এক বার তা-ই জানিয়ে দিল বলেই মত অভিজিৎবাবুর। তিনি বলেন, ‘‘এখনই এই পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রয়োজন আন্দোলন।’’
মনোরোগ চিকিৎসক জয়রঞ্জন রামের আবার বক্তব্য, আসলে বাহ্যিক পরিচয় বা খোলসটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে দিন দিন। যাঁদের সঙ্গে নিত্য ওঠা-বসা, তাঁদের সঙ্গে এক শ্রেণিতে থাকতে পারার ইচ্ছেটাই তাড়া করছে। তার জন্য যে কোনও উপায়ে চাহিদামতো জিনিস সংগ্রহ করতে হবে। কখনও দামি মোবাইল, মোটরবাইক তো কখনও আরও অন্য কিছু। নিউ টাউনের ঘটনা দেখাল, সেই ইচ্ছাপূরণে তাগিদ কোন চরম পর্যায় পৌঁছে দিতে পারে মানুষকে। এগুলিই সামাজিক অবক্ষয়ের নিদর্শন।
সল্টলেকের বাসিন্দা কুমারশঙ্কর সাধুর আবার বক্তব্য, সাবধান হতে হবে বড়দেরই। তিনি বলেন, ‘‘শিশু-কিশোরদের দোষ নয়, তাদের এই মানসিকতার পিছনে অভিভাবকদের ভূমিকা অনেকটাই। ছোটবেলা থেকেই প্রয়োজনের চেয়ে বেশি দামি জিনিস দেওয়ার প্রবণতা থেকে সন্তানদের চাহিদা বাড়ে।’’
তবে এ কথা পুরো মানতে নারাজ অনেকে। যেমন দক্ষিণ কলকাতার এক বাসিন্দার বক্তব্য, ‘‘সন্তান পরিবারের বাইরেও অনেকের সঙ্গে মেলামেশা করে। তাদের দেখেও নানা চাহিদা তৈরি হয়। চারপাশের চাপে পড়েও সন্তানের নানা দাবি পূরণ করতে হচ্ছে এ সময়ের বাবা-মাকে।’’ এই বক্তব্যকে সমর্থন করে বরাহনগরের এক প্রবীণ নাগরিক তমাল রায় বলেন, ‘‘আগে টিভি, মোবাইল, ইন্টারনেট কিংবা রকমারি ফ্যাশনের পোশাকের চল ছিল না। ফলে প্রলোভনও ছিল কম। এখন চার দিকে এত রকমের জিনিস। সবের থেকে সন্তানের নজর বাঁচিয়ে রাখা কঠিন।’’
অর্থাৎ, সকলেরই বক্তব্য এ অসুখ দিন দিন ঢুকছে সমাজের গভীরে। কেউ বেশি অসুস্থ হচ্ছেন, কেউ তুলনায় কম। কিন্তু কী ভাবে তার মোকাবিলা সম্ভব, তা বুঝি জানা নেই কারও। তবে নিউ টাউনের ঘটনার পরে সকলেই যেন আরও সতর্ক। তাঁদের বক্তব্য, এ অসুখ কোন সঙ্কটের দিকে নিয়ে যেতে পারে, তা যে দেখিয়ে দিয়েছে এই মা-ছেলের পরিস্থিতি। কারণ, আপাতত আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন মা। অভিযুক্ত ছেলের ঠাঁই হয়েছে একটি হোমে।