‘আমার নামে নয়’, জানাল কলকাতাও

সাম্প্রদায়িক হিংসার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে বুধবার সামিল হয়েছিল দেশের এক ডজন শহর। কলকাতার আহ্বায়েকরা বলছিলেন, রাজ্যে শাসক দলের তরফেও কেউ কেউ নিজের দলের পতাকা হাতে জমায়েতে আসতে চাইছিলেন।

Advertisement

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০১৭ ০১:৫০
Share:

সরব: সাম্প্রদায়িক হিংসার বিরুদ্ধে একজোট সমাজের নানা মুখ। বুধবার, মধুসূদন মঞ্চ-দক্ষিণাপণ প্রাঙ্গণে। ছবি: সুমন বল্লভ

মোবাইলে তারকার ছবি তুলতে গিয়ে বকুনি খেলেন জনৈক স্থানীয় দোকানদার। বুধবার বিকেলে মধুসূদন মঞ্চের সিঁড়িতে অপর্ণা সেন তাঁকে বললেন, ‘‘এখানে কি শুধু সেলিব্রিটিদের ছবি তুলতে এসেছেন?’’

Advertisement

একটু বাদে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টির সময়ে গোটা জমায়েতের জমি না-ছাড়া তেড়িয়া ভাবটাই কিন্তু বুঝিয়ে দিল, প্রতিবাদের আন্তরিকতা। মধুসূদন মঞ্চ-দক্ষিণাপন চত্বরে অজস্র চেনা-অচেনা মানুষ পরস্পরের ছাতার আশ্রয়ের শরিক হলেন। হাতে ধরা বা বুকে ঝোলানো ‘নট ইন মাই নেম’ লেখা পোস্টার ছাতায় আড়াল করে দাঁড়ালেন, কেজো দিনে অফিস ফেরত প্রতিবাদে সামিল বুড়োবুড়ি, ছেলেমেয়ের দল।

সাম্প্রদায়িক হিংসার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে বুধবার সামিল হয়েছিল দেশের এক ডজন শহর। কলকাতার আহ্বায়েকরা বলছিলেন, রাজ্যে শাসক দলের তরফেও কেউ কেউ নিজের দলের পতাকা হাতে জমায়েতে আসতে চাইছিলেন। তাঁরা সবিনয় না বলেছেন। একটু বাদে গানের তালে হাততালির ফাঁকে ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায় বললেন, ‘‘দলহীন, পতাকাহীন ব্যক্তির দিকেই এখন তাকাতে হবে।’’ ‘নট ইন মাই নেম’ স্লোগান ছুঁয়ে প্রতিবাদের ধারাবাহিকতার কথা বলছিলেন অঞ্জন দত্তও। সেই ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়ে আমেরিকায় প্রতিবাদ থেকে আইএস-এর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ নাগরিকদের প্রতিবাদেও উঠে এসেছিল এই স্লোগান।

Advertisement

আরও পড়ুন: ডায়ালিসিসই হল না, মারা গেলেন প্রসূতি

দেশে গোরক্ষকদের সাম্প্রতিক হিংসার বিরুদ্ধে প্রতিবাদেও সেই পুরনো স্লোগানই হাতিয়ার। অপর্ণা সেন বলছিলেন, ‘‘হিন্দু ধর্ম বা ইসলাম— কেউই হিংসার শিক্ষা দেয় না। অদ্বৈতবাদ বা সুফির উদার মতবাদের এই দেশে এ সব হওয়ার কথা নয়!’’ কে কী খাবেন, পরবেন, তার জেরে হিংসার বাড়বাড়ন্ত যে ভারতের বহুত্ববাদী ধর্মনিরপেক্ষ পরম্পরার সঙ্গে খাপ খায় না, ঘুরেফিরে এই কথাগুলোই উঠে এল।

নানা রঙের ভিড়ে কাছাকাছি দাঁড়ালেন কলকাতার ক্রমশ বিলুপ্ত ইহুদি সমাজের মেয়ে, বিদুষী লেখক ইয়ায়েল সিলিম্যান বা ক্যানিংয়ের বাসিন্দা মতুয়া সমাজের কবিয়াল-গায়ক উত্তম সরকার। সমাজকর্মী রত্নাবলী রায়, দোলন গঙ্গোপাধ্যায়, অঞ্চিতা ঘটকদের সঙ্গেই আড্ডা দিয়ে গেলেন রূপান্তরকামী নারী রায়না। ইয়ায়েল বললেন, ‘‘আমি নারীবাদী। ধর্মের নামে যখন পৌরুষের আস্ফালন চলছে, আমাকে তো আসতে হবেই!’’

মোমিনপুরের সাবির আহমেদ বলছিলেন, ‘‘এই কলকাতাতেই মুসলিম পাড়াগুলো ঘিরে ভুলভাল ধারণা ভাঙা দরকার।’’ মুসলিম জনসংখ্যা বা অনুপ্রবেশ-সমস্যা নিয়ে ভুল ধারণা ভাঙতে পুস্তিকা হাতে হাতে বিলি করছিলেন সন্তোষপুরের সুমন সেনগুপ্ত। মতুয়া যুবক উত্তমবাবু গলায় গাইলেন, ‘ধর্মের মর্ম বুঝিনি, তাই হয়েছি নাস্তিক’! সুরের চরণ ধরে এই আসরে নেমে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, লালন বা জোয়ান বায়েজও। মুম্বই থেকে আসা গীতার উর্দু অনুবাদক সালাউদ্দিনের কবিতাও আলাদা অভিঘাত তৈরি করল।

পিছিয়ে থাকাদের জন্য লরেটো ডে স্কুলের প্রকল্পে শিক্ষিত কন্যা এগারো ক্লাসের কাঞ্চন পাসোয়ান বলেন, ‘‘গরুর মাংস খেলে প্রাণে মারা হচ্ছে, এর পরে কি মাছ খাওয়ার জন্যও ওরা জানে মারবে!’’ আলিয়ঁস ফ্রাঁস্যাজ-এর অধিকর্তা স্তেফান আমালি-র উদ্বেগ, ‘‘সাংস্কৃতিক বহুত্ব নিয়ে লড়াইটা আন্তর্জাতিক ইস্যু হয়ে উঠছে।’’

তত ক্ষণে ফেসবুক লাইভে এই আসরের কথা চাউর করা চলছে। কলেজ শিক্ষকদের একটি দলের আলোচনায় উঠে এল, ‘‘মধুসূদন মঞ্চের সামনে তো মোটামুটি সমমনস্কদের ভিড়! এই অনুষ্ঠানটাই কাছাকাছি স্টেশন-চত্বরটত্বরে করলে কি আরও অনেকের কাছে পৌঁছনো যেত না?’’ চলচ্চিত্র পরিচালক অনীক দত্তও বললেন, ‘‘গান শোনা, চা খাওয়াতেই প্রতিবাদটা শেষ না হয়।’’

সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নিজেদের দিকে তাকানোটাও তো জরুরি! রবীন্দ্রগানের সূত্রে তা মনে করিয়ে মৌসুমী ভৌমিক গাইলেন, ‘আমার এ ঘর বহু যতন করে ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে!’ আহ্বায়েকরা বারবার এই প্রতিবাদ নানা আঙ্গিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বললেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন