প্লাস্টিক জমে মুখ বন্ধ হয়ে গিয়েছে হালতু এলাকার এই নিকাশি খালের। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
আসানসোল পারে। এমনকী পারে কলকাতা পুর-এলাকার লাগোয়া এক ছোট্ট অঞ্চলও। অথচ নিষিদ্ধ প্লাস্টিক বন্ধে এখনও জন-সচেতনতাকে শিখণ্ডী হিসেবে খাড়া করে গা-বাঁচাতে চাইছে কলকাতা পুরসভা।
প্লাস্টিক-যুদ্ধে ময়দানে নেমে আসানসোলের মেয়র জিতেন্দ্র তিওয়ারি সাফ বলেছেন, ‘‘যা বেআইনি, তার ব্যবহার বন্ধ করায় কোনও বাধা মানব না।’’ দক্ষিণ দমদমের বাঙুর অ্যাভিনিউয়ে প্লাস্টিক পুরোপুরি নিষিদ্ধ করতে সফল হয়েছেন সেখানকার পুর-প্রতিনিধি মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য। মূলত তাঁর উদ্যোগে দোকানপাট থেকে গোটা পাড়া, সর্বত্রই বন্ধ হয়ে গিয়েছে নিষিদ্ধ প্লাস্টিকের ব্যবহার।
আর কলকাতা পুরসভা? পরিবেশ দফতরের মেয়র পারিষদ স্বপন সমাদ্দারের মন্তব্য, ‘‘সচেতনতায় অনেক কাজ হয়। জোর করে কিছু না করাই ভাল।’’ সচেতনতা তৈরি হচ্ছে না কেন? কী করছে পুরসভা? কর্তৃপক্ষের কাছে এ সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া এখনও স্বপ্নই। যেমন খোদ মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ই আসানসোলের উদ্যোগকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ হিসেবে দেখছেন। তাঁর কথায়, ‘‘জিতেনদার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। একটা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গিয়ে তিনি জানতে পারেন প্লাস্টিক জমে থাকায় আগুন বেড়ে গিয়েছিল। এর সঙ্গে ওই শহর জুড়ে প্লাস্টিক বন্ধের কোনও অভিযান হয়নি।’’
কলকাতা থেকে প্লাস্টিক বর্জনের প্রচারে বছর তিনেক আগে নামী গায়ক-গায়িকাদের নিয়ে সিডি বার করেছিল কলকাতা পুর-প্রশাসন। টাউন হলে তার উদ্বোধনে মেয়র জানিয়েছিলেন, শহরে ৪০ মাইক্রনের কম ঘনত্বের প্লাস্টিক প্যাকেট ব্যবহার বন্ধ করতে চান তাঁরা। বলা হয়েছিল, শহর জুড়ে সচেতনতার প্রচার চলবে। কাজ না হলে কড়া ব্যবস্থাও নেওয়া হবে। লাইসেন্স নবীকরণের সময়ে প্রত্যেক দোকান, সংস্থাকে মুচলেকা দিয়ে জানাতে হবে নিষিদ্ধ প্লাস্টিক ব্যবহার করা যাবে না।
কিন্তু তিন বছর পরের বাস্তব ছবিটা উঠে এসেছে কলকাতায় প্লাস্টিক-দূষণ নিয়ে এক সাম্প্রতিক সমীক্ষায়। পরিবেশ গবেষণা সংস্থা টক্সিক্স লিঙ্ক-এর করা সেই সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, পরিবেশ বিধি ও প্লাস্টিক দূষণ নিরোধী আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দোকান-বাজারে রমরমিয়ে চলছে নিষিদ্ধ ক্যারিব্যাগের ব্যবহার। ৪০ মাইক্রনের চেয়ে পাতলা প্লাস্টিকের ব্যাগ আইনত নিষিদ্ধ হলেও তা কার্যকর করা হয়নি। ফলে প্লাস্টিক-দূষণ নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগটাই কার্যত ব্যর্থ। পরিবেশ বিধি অনুযায়ী, বিভিন্ন সংরক্ষিত বনাঞ্চল ছাড়াও মহানগরের সুভাষ সরোবর, রবীন্দ্র সরোবর, টালা পার্কের মতো উদ্যানে প্লাস্টিক ব্যাগ নিষিদ্ধ। কিন্তু টক্সিক্স লিঙ্কের গবেষকেরা দেখেছেন, মানুষ প্লাস্টিকের ব্যাগ নিয়েই সেখানে ঢুকছেন। এবং তাতে নজরদারির কেউ নেই। এমনকী, বিভিন্ন সরকারি অফিসের ক্যান্টিনেও পাতলা ক্যারিব্যাগের দেদার ব্যবহারের কথা রিপোর্টে জানিয়েছেন গবেষকেরা।
এর পাশাপাশি শহরের এক পুরকর্তারই বক্তব্য, এ বারের বর্ষাতেও শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে জল জমার কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গিয়েছে, যত্রতত্র প্লাস্টিকের ব্যাগ ফেলার কারণে নর্দমার মুখ আটকে রয়েছে। তার ফলে জল কোনও ভাবেই বেরোতে পারেনি।
পরিবেশবিদেরা বলছেন, প্লাস্টিক জৈব উপায়ে পরিবেশে মেশে না। বরং গৃহস্থবাড়ি বা দোকান থেকে বর্জ্য প্লাস্টিক জমতে জমতে পরিবেশকে আরও বিপন্ন করে তোলে। রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের এক কর্তা বলছেন, প্লাস্টিক পচে না। ফলে দীর্ঘদিন মাটিতে পড়ে থেকে তাকে দূষিত করে তোলে। ভূগর্ভস্থ জলস্তর পূরণের ক্ষেত্রেও বাধা তৈরি করে। এবং এ সবের বাইরে শহরাঞ্চলে নিকাশি বিগড়ে দেয় প্লাস্টিক। তাঁরা জানাচ্ছেন, ধাপায় বর্জ্য প্লাস্টিকে কার্যত পাহাড় তৈরি হয়েছে। শহরতলির বহু এলাকায় খাল-পুকুরের মাঝে জলাশয়ে প্লাস্টিক ফেলায় জল দূষিত হয়ে বিপন্ন হয়ে পড়ছে জলের প্রাণীরা। নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্যও। শহরাঞ্চলে বিভিন্ন নিকাশি নালার মাধ্যমে সরাসরি প্লাস্টিক এসে বিষিয়ে তুলছে গঙ্গার জল।
এ সবের পরেও অবশ্য মেয়র পারিষদ (পরিবেশ রক্ষা) স্বপনবাবু আস্থা রাখছেন জন-সচেতনতাতেই। তিনি জানান, প্লাস্টিক কতখানি ক্ষতি করে তা ছবি ও তথ্য সহযোগে প্রতিটি বরোয় দেখানো হয়। এক-একটি বরোতে বেশ কয়েক বার প্রোজেক্ট মেশিনের সাহায্যে প্লাস্টিকের ক্ষতিকারক দিকগুলো তুলে ধরে মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে। নিষিদ্ধ প্লাস্টিক বর্জনের সমর্থনে শহর জুড়ে হচ্ছে মিছিলও। পরিবেশ দফতরের এক আধিকারিক জানান, বাজারগুলোতেও প্রায়ই নিষিদ্ধ প্লাস্টিক বর্জনের অনুরোধ জানিয়ে প্রচারপত্রও বিলি হয়।
তবে তাতে কতটা কাজ হয় তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে পুর-অফিসার মহলেই। বাজার দফতরের এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘মাসে দু’এক দিন মাইক বাজিয়ে প্লাস্টিক প্যাকেট ব্যবহার করবেন না বললেই তো আর কাজ হয় না। রীতিমতো অভিযান চালানো প্রয়োজন। যা কলকাতায় প্রায় হয়ই না।’’ পুর-স্বাস্থ্য দফতরের এক চিকিৎসক জানান, মানবদেহে নানা রোগের কারণও প্লাস্টিক। অন্য দিকে, নিকাশি দফতরের এক ইঞ্জিনিয়ার জানান, শহরে অধিকাংশ নিকাশি নালায় প্লাস্টিক জমে জল আটকে যায়। এমনকী ম্যানহোলের মুখে প্লাস্টিক জমে বারবারই প্লাবিত হয়েছে শহরের বহু জায়গা।
বাঙুর যেখানে সফল, কেন পারছে না কলকাতা পুর প্রশাসন?
পুরসভার এক আমলা বলছেন, ‘‘সদিচ্ছার অভাব। প্লাস্টিক তৈরির কারখানা, বিক্রির দোকান থেকে শুরু করে সর্বত্রই পুর-প্রশাসনের অবাধ গতি। শয়ে শয়ে ইনস্পেক্টর রয়েছেন পুরসভায়। তাঁদের অভিযানে নামিয়ে দিলে সহজেই নিষিদ্ধ প্লাস্টিক রোখা যেতে পারে।’’ কিন্তু রাজনৈতিক কারণেই ওই সব সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন না পুরসভার নীতি নির্ধারকেরা, মত ওই আমলার।
পরিবেশকর্মীরাও বলছেন, বাঙুরের কাউন্সিলর মৃগাঙ্কবাবু ও প্রশাসন রাজনৈতিক স্বার্থের থেকে নাগরিক সমস্যাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁদের মতে, প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ নিষিদ্ধ করতে হলে উৎপাদকদের লাগাম টানতে হবে। তার ফলে ক্ষমতাসীন দল ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে ব্যবসায়ীদের একাংশ বিরাগভাজন হবেন। পাশাপাশি বিভিন্ন বাজারে প্লাস্টিক-বিরোধী অভিযান চালাতে হবে। কলকাতায় পুর-প্রশাসনের কর্তারা সেই কড়া পদক্ষেপ নিতে চান না। পরিবেশ দফতরের এক পদস্থ আমলার কথায়, ‘‘উৎপাদন বন্ধ করলে সমস্যা হবে। তাই আমরা সচেতনতাকে হাতিয়ার করে এগোতে চাইছি। ’’ কিন্তু শুধু সচেতনতা চালিয়ে যে বিশেষ ফল মিলবে না, সে কথাও ঘনিষ্ঠ মহলে মেনে নিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ‘‘শপিং মলে গিয়ে তো আমরা ক্যারিব্যাগ চাই না। কারণ সেখানে চাইলেও মিলবে না।’’ পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত বলেছেন, ‘‘কারখানাগুলিকে আইনে না বাঁধলে প্লাস্টিক দূষণ ঠেকানো যাবে না।’’
অনেকেরই অভিযোগ, কলকাতা পুর-এলাকায় প্লাস্টিক নিয়ন্ত্রণে পুরকর্তাদের কোনও সদিচ্ছা নেই। যেমন, ভোটে জিতে উত্তর কলকাতার এক কাউন্সিলর ঘোষণা করেছিলেন, ক্যারিব্যাগ-বিরোধী প্রচারে নামবেন। বাস্তবে তা আর হয়নি। তাঁরই ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রে খবর, স্থানীয় ব্যবসায়ীদের চটাতে চাননি তিনি। পর্ষদের খবর, প্লাস্টিক দূষণ নিয়ে পুরসভাকে বারবার বলেও কাজের কাজ হয়নি।
কী ভাবে এই দূষণ রোখা সম্ভব?
পরিবেশবিদদের মতে, ৪০ মাইক্রনের নীচে ক্যারিব্যাগ উৎপাদন আটকাতে হবে। তার বিকল্প কী হতে পারে, সেটাও প্রচার করতে হবে। কলকাতার পরিবেশ ও প্ল্যাস্টিক দূষণ নিয়ে কাজ করা গবেষকদলের অন্যতম সদস্য এবং টক্সিক্স লিঙ্কের প্রোজেক্ট ম্যানেজার মোনালিসা দত্ত বলেন, ‘‘প্লাস্টিকের বিপদ অনেকেই জানেন। কিন্তু বিকল্প কী, জানেন না। পাটের ব্যাগের দাম প্লাস্টিকের থেকে ঢের বেশি। কাগজের ব্যাগ কম টেকসই। তাই প্লাস্টিক ব্যাগের বিকল্প হিসেবে এমন জিনিস বার করতে হবে যা একাধারে পরিবেশ বান্ধব, টেকসই এবং দামেও কম।’’