ছাদ ভরে যায় টিয়ার দলে, নিয়ম রাখেন বৃদ্ধ

এক হাতে একটি কৌটো, অন্য হাতে একটি পাত্র নিয়ে অশক্ত শরীরে সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করলেন খর্বকায় মানুষটি। কারণ, ছাদের চিৎকারটা থামা তো দূরের কথা, বরং আরও বেড়ে গিয়েছে।

Advertisement

সুপ্রকাশ মণ্ডল

শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০১৮ ০৩:৫০
Share:

অতিথি: টিয়াদের বিকেলের ভোজে ব্যস্ত তপনবাবু। খড়দহে। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়

আর একটু সবুর কর বাবা, আসছি। তোদের দেখছি আর তর সয় না।

Advertisement

কলরব কিন্তু থামল না।

এক হাতে একটি কৌটো, অন্য হাতে একটি পাত্র নিয়ে অশক্ত শরীরে সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করলেন খর্বকায় মানুষটি। কারণ, ছাদের চিৎকারটা থামা তো দূরের কথা, বরং আরও বেড়ে গিয়েছে। সিড়ি ভাঙতে ভাঙতে আবারও শুরু হল তাঁর সস্নেহ শাসন।

Advertisement

বয়স হয়েছে তো। আর কি আগের মতো ছুটে-ছুটে যেতে পারি? একটু বোস বাবারা।

বলতে বলতে একতলা বাড়িটার ছাদে পৌঁছলেন ৬৪ বছরের তপন বন্দ্যোপাধ্যায়। ছাদের পাঁচিলে তখন জটলা। বেশ কয়েকটি টিয়া পাখি তারস্বরে চিৎকার করে চলেছে। বৃদ্ধকে দেখে তা বেড়ে গেল বহুগুণ।

তপন কোনও দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে পাঁচিলে চাল আর ভাত দিতে শুরু করলেন। থামল কলরব। টিয়ার দল ব্যস্ত হয়ে পড়ল বৈকালিক ভোজে।

এমনটাই রোজের রুটিন। খড়দহ গোস্বামী পাড়ার বাচ্চা-বুড়োদের কাছে চোখ সওয়া হয়ে গিয়েছে। সকাল-বিকেল দু’বেলার এই টিয়া-ভোজনে দাঁড়ি পড়ে না। তারা খাঁচায় বন্দি নয়, তবুও তাদের পোষ্যই ভাবেন তপন। তিনি বলেন, ‘‘এই ব্যবস্থা তো আজকের নয়। আমার বাবা শুরু করেছিলেন। এখন আমি করছি।’’

তপনের আক্ষেপ, ‘‘আগে শয়ে শয়ে পাখি আসত। ওদের মেলা বসে যেত রীতিমতো। তবে কাক-চিলের বড় অত্যাচার। ওদের ভয়ে পাখি অনেক কমে গিয়েছে।’’ তবে যারা আসে, তাদের নিয়েই দিন কাটে খড়দহ পুরসভার প্রাক্তন কর্মী তপনবাবুর।

দুপুর গড়িয়েছে। তবে বিকেল তখনও নামেনি। পুরনো আমলের বাড়ির একতলার ঘরে পাওয়া গেল তপনবাবুকে। ছাদে যেতে চাওয়ায় বললেন, ‘‘এখন ওরা কেউ আসবে না। চারটে বাজলে ঠিক এসে আমাকে ডাক দেবে।’’ কোথা থেকে আসে পাখিগুলো? দিনমান থাকেই বা কোথায়? তপনবাবু জানালেন, ‘‘ওদের কেউ কেউ থাকে গঙ্গার ধারে গাছগুলোয়। কয়েকটা থাকে বাড়ির কাছের মন্দিরে। আশার কথা আগের থেকে পাখিরা সংখ্যায় এখন বাড়ছে।’’

এর শুরু কবে?

তপনবাবু জানালেন, এর শুরুটা হয়েছিল তাঁর বাবার আমলে। কাছেই গঙ্গা এবং শ্যামসুন্দরের মন্দির। সেখানে প্রচুর টিয়া পাখি থাকত। তাঁদের ছাদে এসে বসত কিছু। তাঁর বাবা তাদের খাবার দিতেন। সেটা ক্রমে পাখিদের রুটিনে পরিণত হয়। তপনবাবু বললেন, ‘‘বাবা তখন নিয়ম করে দু’বেলা খাবার দিতে শুরু করেন। পাখিদের সংখ্যাও দিনদিন বাড়তে শুরু করে।’’

তপনবাবুর বাবার মৃত্যু হয়েছে বছর কুড়ি আগে। পাখিদের নিয়ে ব্যস্ত সংসার সামলালেও বিয়ে করেননি তিনি। কিন্তু কেন? ‘‘এমনিই। ধরে নিন, বিয়েটা আর করা হল না।’’ তাঁর ভাই তাপস বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘ওই পাখিগুলোর জন্য দাদা কোনও দিন বাইরে কোথাও গিয়ে থাকেন না। ভাইয়ের কথা শেষ হতে না হতেই তপনবাবু বলেন, ‘‘আসলে ওরা আমায় খুঁজবে তো দু’বেলা।’’

কথায় কথায় কখন যে ঘড়ির কাঁটা চারটে ছুঁয়েছে, খেয়াল ছিল না। টিয়াদের কলরবে ঘড়ির দিকে তপনবাবু তাকিয়ে দেখেন, ঠিক চারটে। তপনবাবুর মুখের হাসি গর্বিত কর্তার মতো দেখায়। হাতে খাবারের পাত্র নিয়ে সিঁড়ি ভাঙা শুরু হয়।

ছাদের পাঁচিলে তখন খান দশেক টিয়া অপেক্ষায়। তপনবাবু আঙুল তুলে দেখালেন, আরও খান বিশেক টিয়া ছাদের পাশের গাছে বসে তাঁর অপেক্ষায়। তপনবাবু বললেন, ‘‘এদের খাওয়া শেষ হলে, ওরা আসবে। ওরা কিন্তু নিয়ম ভাঙে না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন