মেয়ের চোখ চলে যায় ভাঙা সেতুর দিকেই

শুধু বাড়ির জলজ্যান্ত মানুষটা এখন ঘরের দেওয়ালে ফ্রেম-বন্দি। তবে উত্তর কলকাতার বিবেকানন্দ রোড উড়ালপুল-বিপর্যয়ের শিকার, ২৬ জন মৃতের সরকারি তালিকায় ছবির সেই লোকটার ঠাঁই নেই।

Advertisement

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ৩১ মার্চ ২০১৮ ০২:১৭
Share:

শূন্যতা: রোজ চোখে পড়ে এই ঘাতক উড়ালপুল। ফিরে আসে স্মৃতি। নিজের বাড়ির ছাদে চৈতালি ও পুতুল। শুক্রবার, পোস্তায়। —নিজস্ব চিত্র।

বারান্দার দরজা খুললেই ধ্বংসস্তূপ চোখে পড়ত। সেই ছবিটা এখন পাল্টেছে। সরকার সারিয়েছে ভেঙে চুরমার হওয়া তেতলার গাড়িবারান্দাটাও।

Advertisement

শুধু বাড়ির জলজ্যান্ত মানুষটা এখন ঘরের দেওয়ালে ফ্রেম-বন্দি। তবে উত্তর কলকাতার বিবেকানন্দ রোড উড়ালপুল-বিপর্যয়ের শিকার, ২৬ জন মৃতের সরকারি তালিকায় ছবির সেই লোকটার ঠাঁই নেই। রবীন্দ্র সরণির মুখে এক নম্বর কালীকৃষ্ণ ঠাকুর স্ট্রিটের ওই বাড়িটার ঠিক মুখোমুখি বেসামাল হয় উড়ালপুলের ৪০ নম্বর পিলার বা স্তম্ভ। মানুষটা তখন বাড়িতেই ছিলেন।

তেতলার জানলা দিয়ে উত্তম ভট্টাচার্য দেখেছিলেন, বিকট শব্দ করে সদ্য ঢালাই হওয়া সেতুর অংশ তাঁদের বাড়ির দিকে তেড়ে আসছে। পরে একতলার মন্দিরে বসে সংবাদমাধ্যমকে উত্তমবাবু বারবার বলেনও, ভয় পেয়ে আপ্রাণ দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নামছিলেন তিনি। ছিটকে পড়ে কোমরে চোট পান। কার্যত ঘরহারা পরিবারটির টানাপড়েনের মধ্যেই হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় বছর পঞ্চাশের উত্তমবাবুকে। ৪ এপ্রিল মৃত্যু হয় তাঁর। উড়ালপুল-বিপর্যয়ের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তির মুখে তাঁর স্ত্রী চৈতালি ভট্টাচার্য বলছিলেন, ‘‘পুলটা লোকটার মাথায় ভেঙে পড়েনি তো কী হয়েছে? ওই দুর্ঘটনার জেরেই তো ঘটল বিপর্যয়। সে দিন চোট না পেলে তিনি কিছুতেই এত তাড়াতাড়ি চলে যেতেন না!’’

Advertisement

চৈতালির বড় ননদ পুতুলদেবীর কথায়, ‘‘উড়ালপুলের নীচে যে মানুষগুলি চাপা পড়লেন, তাঁদের আত্মীয়েরা অবশ্য একটা কষ্ট থেকে রেহাই পেয়েছেন। আত্মীয় হারানোর শোকের মধ্যে রাত-দিন ভাঙা ব্রিজের চেহারা, তালগোল-পাকানো কাঠামো আর ধুলোর ঝড়টা দেখতে হয়নি ওঁদের।’’ এখনও দগদগে শোকের স্মারক উড়ালপুলের ৪০ নম্বর স্তম্ভের ভগ্নাংশ। সে দিকে তাকিয়েই চৈতালি, পুতুলেরা বলছিলেন, বাড়ির জলজ্যান্ত মানুষটা চলে গেলেও সেই ডামাডোলে ক্ষতিপূরণের দাবিও করে উঠতে পারেননি ওঁরা! ফলে উড়ালপুল-দুর্ঘটনার শিকার নিহতদের পরিবারের মতো রাজ্য সরকারের পাঁচ লক্ষ টাকা ও কেন্দ্রীয় সরকারের দু’লক্ষ টাকার কানাকড়িও পাননি উত্তমবাবুর পরিজনেরা। বাকিদের মধ্যে ইচ্ছুকদের জন্য ছোটখাটো সরকারি চাকরিও জুটেছে। সে সব নিয়ে অপ্রাপ্তির বোধ নেই। তবে চলতি উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার সময়ে সদ্য তরুণী কন্যা অরিত্রীর অবস্থা দেখলে নিজেকে সামলাতে বেগ পেতে হয় চৈতালিকে।

পড়ার বইয়ের পাতা থেকে মেয়ের চোখও বারবার চলে যায় ভাঙা সেতুর দিকে। দু’বছর আগের সেই দুপুরেও আর কিছু ক্ষণের মধ্যে আদরের মেয়েকে সঙ্গে নিয়েই বেরোনোর কথা ছিল উত্তমবাবুর। অরিত্রী সে বার সবে মাধ্যমিক দিয়েছেন। তিনি বলছিলেন, ‘‘মাধ্যমিকের সময়ে বাবা আগাগোড়া পাশে পাশে ছিল। কোনও ঝক্কিই টের পাইনি! উচ্চ মাধ্যমিকের এই সময়টা তাই বাবার না থাকাটা বড্ড বেশি মনে হচ্ছে।’’ উত্তম-চৈতালির ছেলে কৌশিক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার কর্মী। এ ছাড়া, বাড়ির নীচেই পারিবারিক কালী মন্দির। বাড়িতে বসে বাইরের দুর্ঘটনায় বিনা মেঘে বাজ পড়ার মতো ঘরের লোকটা চলে যাওয়ার ক্ষত থেকে ওঁরা বেরোতে পারেননি।

সরকার ভাঙা বারান্দা সারালেও বাড়ি সারানোর লক্ষ চারেক টাকা ভট্টাচার্যদের নিজেদেরই বইতে হয়েছে। আশপাশের বাড়ির চেহারা-চরিত্রেও দু’বছরে বদল এসেছে। উত্তমবাবুদের বাড়ির পাশেই কয়েকটি বাড়ির উপরের তলা ভাঙা হয়েছে। তবু কাটেনি আতঙ্ক। চৈতালি বলছিলেন, ‘‘সেতুর নীচে দাঁড়ালে ফাঁক দিয়ে আকাশ চোখে পড়ে। টিকে থাকা অংশটুকু রেখে কী যে লাভ! রোজ ভয় হয়, এই বুঝি ফের সব হুড়মুড়িয়ে মাথায় পড়ল!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন