সচেতনতা: ‘বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস’-এ প্রচার আক্রান্ত শিশুদের। মঙ্গলবার, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে। ছবি:বিশ্বনাথ বণিক
বছর সাতাশের মেয়েটির দিব্যি প্রাক-বিবাহ প্রেমপর্ব চলছে। বিয়ের দিনও স্থির হয়ে গিয়েছে। ‘সচেতন’ নাগরিক হিসাবে ওই যুগল বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা করান। রক্ত পরীক্ষায় জানা যায়, মেয়েটি থ্যালাসেমিয়া-র বাহক। সেই রিপোর্ট পেয়েই কখনও পাহাড়ে চড়া আবার কখনও সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়ানো মেয়ে হয়ে ওঠেন ‘দুর্বল’। ক্লিনিক থেকে ক্লিনিকে হবু বউকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন শ্বশুরবাড়ির লোকেরা। ‘স্বাভাবিক’ ছেলের সঙ্গে কি বিয়ে দেওয়া যায়? সন্তান জন্মালে কতখানি ঝুঁকি থাকবে? এমন নানা প্রশ্নে জেরবার হয়ে উঠেছিলেন তরুণী। শেষে সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হন তিনি।
থ্যালাসেমিয়ার বাহক হওয়ায় বহু তরুণীকে নানা ভাবে হেনস্থার শিকার হতে হচ্ছে। কখনও আত্মীয়দের কাছে আবার কখনও বিবাহ পর্বে ‘রোগী’ তকমা লাগিয়ে দেওয়ার প্রবণতা তৈরি হচ্ছে। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং চিকিৎসকেরা একযোগে বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সচেতনতার প্রচার চালান। থ্যালাসেমিয়া রুখতে রক্ত পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তার বার্তাও তুলে ধরা হয়। ৮ মে বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবসে শহর জুড়ে সচেতনতা কর্মসূচি চলছে। কিন্তু এমন ঘটনা সামনে আসায় এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা সংগঠনের কর্মীরা জানাচ্ছেন, ফের প্রমাণ হল সচেতনতা দূর অস্ত্, মানবিকতা বোধটুকুও তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।
চিকিৎসকদের একাংশ জানাচ্ছেন, থ্যালাসেমিয়ার বাহকের অর্থ কিন্তু তিনি থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত নন। এ দেশে অধিকাংশ মেয়েই রক্তাল্পতায় ভোগেন। পুষ্টির অভাবেই এ সমস্যা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কম হওয়ার কারণ, রক্তে আয়রনের অভাব। কিন্তু ভ্রান্ত ধারণা কাটাতে না পারলে সমস্যা বাড়বে। বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষার কারণ, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার হাত থেকে বাঁচানো। কিন্তু কেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকতে পারে, তার বৈজ্ঞানিক দিক সম্পর্কেও জানা জরুরি।
এনআরএস-এর হেমাটোলজি বিভাগের চিকিৎসক প্রান্তর চক্রবর্তী বলেন, ‘‘এমন ঘটনা ফের মনে করিয়ে দেয় আমরা মানুষকে কিছুই বোঝাতে পারিনি।’’ তিনি জানান, রক্তাল্পতার সমস্যার কারণ প্রত্যেকের দেহে আলাদা। একটা সমস্যার সঙ্গে অন্যটি মিশিয়ে দিয়ে তকমা দিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। রোগের বাহক ও রোগী আলাদা। সে সম্পর্কে সতর্ক হওয়া দরকার।
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইনস্টিটিউট অব হেমাটোলজির অধিকর্তা মৈত্রেয়ী ভট্টাচার্য জানান, এক জন থ্যালাসেমিয়ার বাহকের সঙ্গে আরও এক জন বাহকের বিয়ে হলে তবেই সন্তানের থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। দু’জনের মধ্যে এক জন বাহক হলে সমস্যা নেই। তাঁর কথায়, ‘‘থ্যালাসেমিয়ার বাহক কোনও ভাবেই রোগী নন। কিন্তু এই ধারণা অধিকাংশের নেই। ফলে অনেকেই নানা হেনস্থার শিকার হন। বিশেষত মহিলাদের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও প্রতিকূল হয়ে উঠে।’’