চুল-দাড়ি কাটলে ৪০, শাহরুখ-সলমন ছাঁট হলে রেট বেশি

চুল-দাড়ি ৪০ টাকা| দাড়ি ১০ টাকা। স্পেশ্যাল ক্রিম ১৫ টাকা। সাধারণ ছাঁট ৩০-৩৫ টাকা। শাহরুখ বা সলমন কাটের রেটটা একটু বেশি।

Advertisement

আর্যভট্ট খান

শেষ আপডেট: ১৯ মে ২০১৮ ০২:৪৪
Share:

নরসুন্দর: রাস্তার ধারে চেয়ার পেতে চলছে কেশসজ্জা। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

একটা বন্ধ দোকানের দরজার উপরে ঝুলছে আয়না। তার চার ধারে শুধুই নায়ক আর পুরুষ মডেল। নারীচরিত্র বর্জিত আয়নার সামনে কাঠপুতুলের মতো বসে এক যুবক। কাঁচি আর বিভিন্ন মাপের চিরুনি হাতে সেই মুখে তখন রণবীরের ছাপ দিতে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন এক মধ্যবয়স্ক।

Advertisement

চাঁদনির ফুটপাতের বৈদ্যুতিন সরঞ্জামের মাঝেই একটা চেয়ার পেতে আর আয়না ঝুলিয়ে কুড়ি বছর ধরে এ ভাবে ব্যবসা করে চলেছেন গয়ার বাসিন্দা উমেশ কুমার। নায়কদের ছবি কেন? হাসতে হাসতে জানান, ওটা তো ক্যাটালগ! শুধু আঙুল দিয়ে পছন্দসই কাট দেখিয়ে দিলেই হল| তাঁর দাবি, ‘‘চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি, ঠান্ডাঘরের সেলুনে বসা নাপিতদের থেকে খারাপ চুল কাটি না। অনেক খদ্দের আছেন, যাঁরা কাজে শহরের বাইরে গেলেও চুল-দাড়ি কাটতে আমাকেই ভরসা করেন।’’

চুল-দাড়ি ৪০ টাকা| দাড়ি ১০ টাকা। স্পেশ্যাল ক্রিম ১৫ টাকা। সাধারণ ছাঁট ৩০-৩৫ টাকা। শাহরুখ বা সলমন কাটের রেটটা একটু বেশি। মোটামুটি এ রকমই রেটে চলে এ শহরের ‘ইটালিয়ান সেলুন’। মজা করে এমন নামেই এর পরিচিতি। কারণ ফুটপাতে চোখ ঘোরালে খোলা আকাশের নীচে দেখা যায়, ইট, পাথর বা টুলের উপরে বসে আছেন খদ্দের। সামনে চুল কেটে চলেছেন নাপিত। অবশ্য বাতের ব্যথার সৌজন্যে এখন ওঁদের ভরসা চেয়ারেই। হোক না সে গাছের তলা বা ফুটপাতের এক চিলতে পরিসর। হাতিবাগানের এমনই এক নাপিত বলেন, ‘‘বেশির ভাগ খদ্দেরের হাঁটুর সমস্যা। খদ্দের কমে যাচ্ছিল, তড়িঘড়ি চেয়ার জোগাড় করেছি।’’

Advertisement

রোগের সঙ্গে যুঝে চলেছেন অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তী। অথচ এক সময়ে তাঁর চুলের ছাঁট নকল করার চাহিদা ছিল সবচেয়ে বেশি। চাঁদনি এলাকার এমনই এক সেলুনের নাপিত বলেন, ‘‘নায়কদের মধ্যে সব থেকে চাহিদা ছিল মিঠুন কাটের। এমন চাহিদা আর দেখিনি। অমিতাভ কাটের চাহিদাকে টেক্কা দিয়েছিল। আট-নয়ের দশকে সবাই এসে বলতেন মিঠুন কাট চাই। তখন তো তিন থেকে চার টাকায় চুল কাটা হত। খদ্দের মিঠুন কাটে সন্তুষ্ট না হলে ঝগড়াও হাতাহাতি হওয়ার জোগাড় হত।’’

মুটে, মজুর, রিকশাওয়ালা, দোকানদার, বাস-ট্রাক-ট্যাক্সিচালক অফিসের ছোটবাবু, মেজবাবু কে নেই ওঁদের খদ্দেরের তালিকায়? মধ্য কলকাতার এক ব্যবসায়ী রাকেশ যাদব হেসে বলেন, ‘‘আমার পাশেই তো ইটালিয়ান সেলুন। বড় সেলুনে গেলে লাইন দিতে হয়। এত সময় কোথায়? তাই এখানে ফাঁকা দেখলেই বসে পড়ি।’’ বউবাজার এলাকায় হাতে টানা রিকশা চালান বাবু মল্লিক। তাঁর শখ একটাই, গোঁফের সাইজ ঠিক রাখা। বাবু বলেন, ‘‘এ জন্য সপ্তাহে এক দিন তো যেতেই হয়। আমাদের তো ওই সেলুনই ভরসা।’’ আবার বড়বাজারের এক দোকানের ছোটবাবু বিজয় তিওয়ারির যেমন বাড়িতে দাড়ি কাটার সময় নেই। তাই তাঁরও ভরসা ইটালিয়ান সেলুন। শীতের মিঠে রোদ পিঠে নিয়ে দাড়ি কাটার মজাই আলাদা, জানালেন বিজয়।

বিজয়ের ইটালিয়ান সেলুনে বড় আয়না রয়েছে। কিন্তু সব ইটালিয়ান সেলুনে বড় আয়না নেই। যেমন চাঁদনি এলাকার লক্ষ্মণ ঠাকুরের ইটালিয়ান সেলুনে বড় আয়না নেই। চুল কাটতে কাটতে একটা ছোট আয়না দিয়ে মাঝেমধ্যে চুল কেমন কাটা হল, তা দেখিয়ে দেন। তবু খদ্দের আসেন বিশ্বাসের উপরে ভর করে, জানালেন লক্ষ্মণ। তবে চুল-দাড়ি কাটার সময় তাঁরা প্রত্যেকের জন্যে নতুন ব্লেড ব্যবহার করেন। অনেক খদ্দের আবার নিজেই সঙ্গে আনেন পছন্দসই ব্র্যান্ডের ব্লেড। সুগন্ধি আফটার শেভও মিলবে ওঁদের কাছে। কারও কারও কাছে পাওয়া যায় মাত্র পনেরো টাকায় মালিশ, তেল মালিশ...।

এ শহরের ইটালিয়ান সেলুনের অনেক নাপিতই বিহারের গয়ার বাসিন্দা। দু-তিন পুরুষ কাটিয়ে দিয়েছেন শহরের ফুটপাতে। ওয়েলিংটনের নাপিত অজয় তিওয়ারির আক্ষেপ, ‘‘বহু দিন গ্রামেযাওয়া হয় না। মন খারাপ তো করেই। গ্রাম থেকে কেউ কলকাতা এলে দেখা করে যান। ক’দিন আগে এক কাকা এসেছিলেন। সঙ্গে এনেছিলেন বাড়ির পাঠানো নাড়ু।’’

বাড়ির সেই সুবাস ওঁদের কাছে শীতলপাটির সমান। অন্তরে যা সঙ্গোপনে বিছিয়ে রেখেই এ শহরের ফুটপাতে চলে ওঁদের দিনযাপন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন