বইপাড়ায় আড্ডা আছে, মিষ্টি কম

বৈশাখী আড্ডায় বইসঙ্গী ‘টই’, অর্থাৎ অধিকাংশ প্রকাশকের ঘরেই আড্ডার খাবারে বদল এসেছে। মিষ্টি নয়, নোনতা চাই। বেশির ভাগ লেখক-কবিই তো সুগারের রোগী।

Advertisement

দেবাশিস ঘড়াই

শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৮ ০২:১৮
Share:

প্রস্তুতি: বর্ষবরণের ব্যস্ততা। উত্তর কলকাতার এক দোকানে গোছানো হচ্ছে নতুন বছরের বাংলা ক্যালেন্ডার। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

প্রথাগত মিষ্টির জায়গায় ‘ডায়েট’ নরম পানীয়, সুগার-ফ্রি সন্দেশ। সঙ্গে নোনতা। মধু থেকে যত দূরে থাকা যায়, ততই ভাল! শব্দের স্বাস্থ্য অটুট রাখতে হলে নিজেদেরও যে সুস্থ থাকতে হবে।

Advertisement

তাই বৈশাখী আড্ডায় বইসঙ্গী ‘টই’, অর্থাৎ অধিকাংশ প্রকাশকের ঘরেই আড্ডার খাবারে বদল এসেছে। মিষ্টি নয়, নোনতা চাই। বেশির ভাগ লেখক-কবিই তো সুগারের রোগী।

কলকাতা বইমেলা তখনও শুরু হয়নি। সে আমলে কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়াতেই নতুন বাংলা বই প্রকাশের অনুষ্ঠান হত। প্রকাশকদের একাংশ পয়লা বৈশাখের সেই ধারাকে অক্ষুণ্ণ রাখলেও নতুন বই প্রকাশ এখন মূলত বইমেলা-কেন্দ্রিক।

Advertisement

বই প্রকাশের সেই সংস্কৃতির সঙ্গে বদল এসেছে বই-আড্ডার সহযোগী মুখরোচক খানাতেও। এক সময়ে ডাবের শাঁস, হরেক মিষ্টি আর তেলেভাজাই ছিল বৈশাখী বই-পার্বণের অন্যতম আকর্ষণ। আড্ডার সঙ্গে মুখ চলত অনর্গল। এমনকী, লেখক-কবিরাও প্রকাশকদের কাছে আবদার করতেন, ‘ওই মিষ্টিটা যেন থাকে! খেতে আসব!’ এখনও যে তেমনটা নেই, তা নয়। কিন্তু সুগার ও অন্যান্য রোগভোগের দাপটে সেই প্রথায় পরিবর্তন এসেছে।

কুমোরটুলিতেই বেছে নেওয়া পুজোর লক্ষ্মী-গণেশ। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।

বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ-এর সভাপতি বারিদবরণ ঘোষ বলেন, ‘‘লেখক-কবিদের তো অধিকাংশেরই সুগার। তাই মিষ্টির পরিবর্তে এখন নোনতারই আধিক্য।’’ পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ড-এর সভাপতি ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আড্ডার মেনু তো পাল্টেছেই। এখন সুগার-ফ্রি মিষ্টি, ডায়েট কোল্ড ড্রিঙ্কস এসেছে। সুগারের ভয়ে কেউ পারতপক্ষে মিষ্টি খান না।’’ মিত্র অ্যান্ড ঘোষ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড-এর প্রধান সম্পাদক সবিতেন্দ্রনাথ রায়ের কথায়, ‘‘মিষ্টির চলটা কমেছে। আলুর দম, ঘুঘনি থাকে আড্ডায়। তবে তার মধ্যেও অনেকে মিষ্টির খবর নেন।’’

নবীন প্রজন্মের লেখকেরাও বলছেন, স্বাস্থ্য সচেতন হতেই বৈঠকি আড্ডায় নোনতা ক্রমশ জায়গা করে নিচ্ছে। লেখক স্মরণজিৎ চক্রবর্তী বললেন, ‘‘আমি নিজে মিষ্টির খুব একটা ভক্ত নই। কিন্তু বাঙালি সাধারণ ভাবে স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে উঠেছে। তাই মিষ্টি এড়িয়ে চলছে তারা।’’ কবি শ্রীজাত আবার বলছেন, ‘‘অনেকেই স্বাস্থ্য সচেতন হওয়ায় আড্ডায় মিষ্টি কমেছে ঠিকই। কিন্তু প্রকাশকদের আপ্যায়নে যে মিষ্টত্ব আছে, তাতে তো আর সুগার বাড়ে না!’’

এক কালে পয়লা বৈশাখই ছিল নতুন বই প্রকাশের একমাত্র সময়। কিন্তু সত্তরের দশকে বইমেলা শুরু হওয়ার পরেই তা বদলে যায়। আনন্দ পাবলিশার্সের ম্যানেজিং ডিরেক্টর সুবীর মিত্র বললেন, ‘‘নববর্ষে এক সময়ে অনেক বই বেরোত। কিন্তু বইমেলা আসার পরে সেখানেই বই প্রকাশিত হতে শুরু করে। কিন্তু আমরা আগে যে রকম বই প্রকাশ করতাম, এখনও সেই ধারা বজায় রেখেছি। পয়লা বৈশাখে ২৫টি বই প্রকাশিত হবে। তা ছাড়াও সারা বছরই চেষ্টা করি বই প্রকাশ করার। তবে এটাও ঠিক, বইমেলাতেই বেশি সংখ্যক নতুন বই প্রকাশিত হয়।’’

বদল এসেছে প্রকাশকদের ঘরের আড্ডাতেও। আগে বাংলা সাহিত্যের জ্যোতিষ্কেরা আসতেন বইপাড়ার বৈশাখী আড্ডায়। কিন্তু এখন তেমনটা আর দেখা যায় না বলেই জানাচ্ছেন সাহিত্যিকদের একাংশ। সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এই সময়ে আমি আশ্রমে চলে যাই। বইপাড়ায় পয়লা বৈশাখে আগে কয়েক বার গিয়েছি। কিন্তু মুড়ি-চপ সহযোগে দীর্ঘক্ষণের যে আড্ডা, সেটা এখন আর হয় বলে মনে হয় না!’’ সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার বলছেন, ‘‘প্রবীণ সাহিত্যিকেরা শারীরিক অসুস্থতা ও অন্য অনেক কারণে পয়লা বৈশাখের বই প্রকাশ অনুষ্ঠান থেকে সরে গিয়েছেন। তাঁদের আর বইপাড়ার আড্ডায় দেখা যায় না।’’

যদিও গিল্ড জানাচ্ছে, ২০১৪ থেকে কলেজ স্কোয়ারে শুরু হওয়া ‘নববর্ষ বই উৎসব’ বইয়ের প্রকাশনী-পার্বণে ফের নতুন করে মাটি খুঁজে পাচ্ছে। প্রথম বছরে যেখানে ২০ লক্ষ টাকার নতুন বাংলা বই বিক্রি হয়েছিল, সেখানে গত বছর বই বিক্রি হয়েছে প্রায় কোটি টাকার! ত্রিদিববাবুর কথায়, ‘‘কলকাতা বইমেলায় যেখানে প্রায় ৭৫০ স্টল দেওয়া যায়, সেখানে কলেজ স্কোয়ারে ৭১টি মাত্র স্টলের জায়গা আছে। বই প্রকাশের হারও আগের থেকে ২০ শতাংশ বেড়েছে।’’ তবে কবি-লেখকেরা চাইছেন, শুধুই বই উৎসবে সীমাবদ্ধ না থেকে পাঠকস্রোত ছড়িয়ে পড়ুক, ঢুঁ মারুক বইপাড়ার বৃহত্তর প্রকাশনার জগতেও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন