বাধা জয় করেই মেয়েরা এ বার পেশাদার চালক

আর হয়নি বলেই শহরের বহু বাড়িতে এখন পারিবারিক গাড়িচালক হিসেবে কাজ করছেন মেয়েরা। ‘ড্রাইভার সাহেব’ বা ‘ড্রাইভারজি’র বদলে ‘ড্রাইভারদিদিদের’ নিয়ে মালিক-মালকিনরাও সন্তুষ্ট।

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০১৮ ০৩:০৪
Share:

চালকের আসনে মানসী।

যে শহরে অটো চালানোর প্রশিক্ষণ নিয়েও পুরুষদের বাধায় মেয়েদের পিছিয়ে আসতে হয়, সেই শহরে গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে পেশাদার চালক হিসেবে বসাটাও যে মেয়েদের পক্ষে সহজ হবে না, সেটাই বোধহয় স্বাভাবিক। সেই নিয়ম মেনে বাধা কম আসেনি। তবে অটোর ক্ষেত্রে মেয়েরা হার মানলেও গাড়ির ক্ষেত্রে অবশ্য তা হয়নি।

Advertisement

আর হয়নি বলেই শহরের বহু বাড়িতে এখন পারিবারিক গাড়িচালক হিসেবে কাজ করছেন মেয়েরা। ‘ড্রাইভার সাহেব’ বা ‘ড্রাইভারজি’র বদলে ‘ড্রাইভারদিদিদের’ নিয়ে মালিক-মালকিনরাও সন্তুষ্ট।

আপাতত চোদ্দো জন মেয়ে কলকাতায় পারিবারিক গাড়িচালকের কাজ করছেন। সর্বভারতীয় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এঁদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। সংস্থার প্রোগ্রাম ডিরেক্টর দোলন গঙ্গোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘মেয়েরা যখন প্রথম জুতো পরেছে, তখনও টিটকিরি শুনেছে। যখন প্রথম স্কুলে গিয়েছে, প্রথম ডাক্তার হয়েছে, তখনও তাঁদের দুয়ো দিয়ে ঘোমটার আড়ালে ঢোকানোর চেষ্টা হয়েছে। সেই ঐতিহ্য অব্যাহত। কিন্তু তা অগ্রাহ্য করার উপায় মেয়েদের জানা আছে।’’ তাঁদের সংস্থার বিভিন্ন কর্মসূচির উদ্দেশ্য একটাই— এমন এক কাজের দুনিয়া তৈরি করা, যেখানে শুধু ছেলেদের বা শুধু মেয়েদের কাজ বলে ভাগাভাগিটা থাকবে না।

Advertisement

সেরিনা, মানসী, পিঙ্কি, ফাল্গুনী, পল্লবী-রা যখন প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, তখন তাঁদের মানসিক স্থৈর্য ও দৃঢ়তা বজায় রাখার কৌশল এবং আত্মরক্ষার জন্য মার্শাল আর্টও শেখানো হয়েছে। একুশ বছরের ফাল্গুনী হাসতে হাসতে বলছিলেন, ‘‘প্রথমে আমাদের দেখে লোকে মনে করে, আমরা বোধহয় নিজেদের গাড়ি চালাচ্ছি। তার পরে যখন দেখে, পিছনের সিটে লোক বসে আছে, তখন বোঝে আমরা ড্রাইভার। হাঁ হয়ে থাকে, ফিসফিস করে, ঘাড় ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে দেখে। কেউ কেউ টিটকিরি ছুড়ে দেয়। কিছু পুরুষ ড্রাইভার ইচ্ছা করে গাড়ি চেপে দেয়, ঘষে দেয়, হর্ন দিতে থাকে। আমি যখন পাল্টা ওদের গাড়ি চাপি, তখন হকচকিয়ে যায়।’’

ফাল্গুনী। নিজস্ব চিত্র

ফাল্গুনী গাড়ি চালান আইনজীবী সারদা হরিহরনের। সারদা বললেন, ‘‘আমার অভিজ্ঞতা বলছে, অধিকাংশ উত্তর ও পশ্চিম ভারতীয় গাড়িচালকই মহিলা মালিকদের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেন না। মেয়েদের নির্দেশ মানতে তাঁদের আঁতে লাগে। অনেকেরই সিগারেট-মদের নেশা থাকে। মহিলা চালক সব দিক থেকেই নিরাপদ।’’ একই অভিমত স্কুলশিক্ষিকা মহুয়া চট্টোপাধ্যায়ের। যিনি আবার অভিনেতা শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী। মহুয়া বলেন, ‘‘ভীষণ স্বস্তিতে থাকি মেয়ে ড্রাইভার নিয়ে। আমার সুবিধা-অসুবিধা বোঝে। কিশোরী মেয়েকে নিশ্চিন্তে ওর সঙ্গে ছাড়তে পারি। তা ছাড়া, মেয়েরা প্রকৃতিগত ভাবে ভদ্র, নিয়মানুবর্তী হয়।’’ মহুয়ার গাড়ি চালান সেরিনা খাতুন। ভরপুর আত্মবিশ্বাস নিয়ে সেরিনা বলেন, ‘‘পুরুষ ড্রাইভারদের অনেকে প্রশ্ন করেন, আমি কেন এই পেশায় এলাম। কেউ আবার বলেন, ‘মেয়েরা সব ঢুকে পড়ছে, আমাদের ভাত মারা যাবে’। অনেকে আবার প্রশংসা করেন, উৎসাহও দেন। নিজের বাড়ির মেয়েদের প্রশিক্ষণ দেওয়াবেন বলে সংস্থার ফোন নম্বর চান।’’

ক্যানিংয়ের মানসী মিদ্যা এখন টালিগঞ্জে এক অবাঙালি পরিবারের গাড়িচালক। ভবানীপুরের এক মারোয়াড়ি পরিবারের গাড়ি চালান পিঙ্কি নস্কর। ঢাকুরিয়ার একটি বাঙালি পরিবারের চালক পল্লবী। এই পল্লবী আবার রূপান্তরিত নারী। তাঁর জীবনের লড়াই আরও একটু কঠিন। তবে, একটা কথা এঁরা সবাই মেনে চলেন— কে কী বলল, তা নিয়ে ভাবলে চলবে না। কেউ গালি দিয়ে যাবে, কেউ ওভারটেকের চেষ্টা করবে। কিন্তু স্টিয়ারিং শক্ত হাতে ধরতে জানলে কারও ক্ষমতা নেই উল্টে ফেলার, তা সে রাস্তায় হোক বা জীবনে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন