বছরে ৪৫ হাজারেরও বেশি ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদনকারীদের টেস্ট ড্রাইভ নিতে হবে। ডাক পড়ে ন’জনের।
বছরে ৪০ হাজারের মতো গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট দিতে হবে। তার দায়িত্বও ওই ন’জনের ঘাড়েই।
আবার মুখ্যমন্ত্রীর কনভয়ের গাড়ির কলকব্জা ঠিকঠাক আছে কি না, সপ্তাহে দু’দিন তা পরীক্ষা করে শংসাপত্রও দেওয়ার ভারও তাঁদেরই।
কলকাতার রাস্তায় দুর্ঘটনা ঘটলে তো আর কথাই নেই। ওই ন’জনের কাউকেই দৌড়তে হবে ঘটনাস্থলে।
ওঁরা কলকাতার পরিবহণ দফতরের টেকনিক্যাল ইনস্পেক্টর। দিনের পর দিন এমন পাহাড়প্রমাণ কাজের ভারে তাঁরা কার্যত ন্যুব্জ। ২১ জনের বরাদ্দ কাজ ওই ন’জনকেই করতে হয়। কলকাতা পরিবহণ দফতরের টেকনিক্যাল বিভাগই নয়। এমন দশা ওই দফতরের সব বিভাগেরই— কার্যত লোক-লস্করহীন নিধিরাম সর্দার।
তার মধ্যেই ঢাক-ঢোল পিটিয়ে কলকাতা পরিবহণ দফতর একটি কেন্দ্র থেকে বেড়ে তিনটি হয়েছে। ফল যা হওয়ার, হয়েছেও তা-ই। নিয়মরক্ষার কাজ করতেই দিন ফুরোচ্ছে দফতরের কর্মীদের। রাস্তায় নেমে নজরদারি দূর অস্ত্। সময়ের মধ্যে পরিষেবা দিতে হিমশিম কর্মীরা। পরিবহণ দফতর সূত্রের খবর, আরও কর্মীর জন্য বারবার নবান্নের কাছে দরবার করেও কোনও সুরাহা হয়নি। আশ্বাসই মিলেছে শুধু।
পরিবহণ দফতরের এক কর্তা জানান, সাধারণ মানুষের কাছে সঠিক সময়ে পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে ২০১৩ সালে বেলতলার পিভিডি-র কাজ কিছুটা কমিয়ে কসবা ও সল্টলেকে দু’টি নতুন বিভাগ খোলা হয়। কিন্তু নতুন শাখা খুললেও কাজ করার জন্য পর্যাপ্ত কর্মী নিয়োগ হয়নি। ফলে সাধারণ মানুষের সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই হয়েছে বেশি।
পরিবহণ দফতর সূত্রের খবর, বর্তমানে দফতরে কর্মীর সংখ্যা হওয়া উচিত অন্তত ৪৭৭। সে জায়গায় কর্মী রয়েছেন ২০৩ জন। সব চেয়ে শোচনীয় অবস্থা ‘লোয়ার ডিভিশন ক্লার্ক’ (এলডিসি) বা কেরানি পদে। অনুমোদিত পদের সংখ্যা ৯৮। আছেন মাত্র দু’জন। এক পরিবহণ কর্তার কথায়, ‘‘প্রায় ন’বছর কেরানি পদে নিয়োগ হয়নি। এ বার এলডিসি যাঁরা ছিলেন, তাঁদের পদোন্নতি হয়ে আপার ডিভিশন ক্লার্ক (ইউডিসি) হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু শূন্যপদ পূরণ হয়নি।’’ একই ভাবে নন-টেকনিক্যাল ইনস্পেক্টর পদে ২২ জনের জায়গায় রয়েছেন ১২ জন। আর গ্রুপ ডি কর্মী কার্যত নেই। ৪৮ জনের জায়গায় মাত্র এক জন। কোনও রকমে অস্থায়ী ভাবে নিয়োগ করে কাজ চালানো হচ্ছে। ওই কর্তা বলেন, ‘‘কলকাতা পরিবহণ দফতর শুধু বেলতলায় থাকাকালীন তা-ও কোনও রকমে কাজ চলছিল। কিন্তু তিন ভাগ হওয়ার পরে সাকুল্যে এক-একটি শাখায় কর্মীর সংখ্যা ৬০-৭০ জন। কাজ করা অসম্ভব হয়ে পড়ছে।’’
বেলতলায় কলকাতা পরিবহণ দফতরের (পিভিডি) একাংশের দাবি, কর্মীর সংখ্যা পর্যাপ্ত না থাকায় কাজে অনেক ক্ষেত্রেই গাফিলতি থেকে যাচ্ছে। যার মাসুল দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকেই। এক কর্তার মতে, কম সময়ে তাড়াহুড়ো করে গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট দিতে গিয়ে কাজে গলদ থেকে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, গাফিলতি থাকছে এনফোর্সমেন্ট ব্রাঞ্চের নজরদারিতেও। তৃতীয়ত, টেস্ট ড্রাইভও সঠিক ভাবে করাতে পারছেন না ইনস্পেক্টররা। নিয়ম মেনে প্রতিটি টেস্ট ড্রাইভের ক্ষেত্রে কমপক্ষে আট মিনিট সময় দেওয়া দরকার। সেখানে কোনও রকমে দু’মিনিটে দেখে নিয়েই ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে। ফলে যাঁরা পাশ করছেন, তাঁদের লাইসেন্স নিয়ে অনেক প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
এত কিছুর পরেও অবশ্য এ নিয়ে হেলদোল নেই পরিবহণ দফতরের। যদিও নবান্নের শীর্ষ কর্তাদের দাবি, তাঁদের কাছে এমন খবর ছিল না। সম্প্রতি পরিবহণমন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী বিষয়টি জানার পরে পদক্ষেপ করেন। কর্মিবর্গ প্রশাসন দফতরকে শূন্য পদে নিয়োগের আর্জিও জানানো হয়েছে। তবে আপাতত অস্থায়ী কর্মী দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইছে সরকার। পাকাপাকি ভাবে নিয়োগ কবে হবে, তা নিয়ে অবশ্য কিছু বলতে পারছেন না তাব়ড় পরিবহণ কর্তারাও।