লালবাজার

ভোটে কেন কম্যান্ডো, পুরনো সিপি ফিরতেই সুর বদলাচ্ছে বাহিনী

সোজা শিরদাঁড়া বাঁকানোর পর্ব শুরু হতেই ভোটে কলকাতা পুলিশের ভূমিকা নিয়ে বাহিনীর মধ্যেই উঠল প্রশ্ন। জঙ্গি দমনে প্রশিক্ষিত বাহিনীকে যে ভাবে ভোটের কাজে লাগানো হয়েছিল, প্রকাশ্যে সে সিদ্ধান্তের সমালোচনা করল লালবাজারের একাংশ।

Advertisement

সুরবেক বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০১৬ ০১:৫৪
Share:

সোজা শিরদাঁড়া বাঁকানোর পর্ব শুরু হতেই ভোটে কলকাতা পুলিশের ভূমিকা নিয়ে বাহিনীর মধ্যেই উঠল প্রশ্ন। জঙ্গি দমনে প্রশিক্ষিত বাহিনীকে যে ভাবে ভোটের কাজে লাগানো হয়েছিল, প্রকাশ্যে সে সিদ্ধান্তের সমালোচনা করল লালবাজারের একাংশ।

Advertisement

জঙ্গি দমনে প্রশিক্ষিত, কলকাতা পুলিশের বিশেষ বাহিনীকে ভোটের ডিউটি দিয়ে তাদের শক্তির অপচয় করা যাবে না। পুলিশ কমিশনার পদে ফিরে আসা রাজীব কুমারের কাছে এই আর্জিই এ বার জানাবেন লালবাজারের কর্তাদের একাংশ। প্রয়োজনে এই ব্যাপারে নিয়মও তৈরি হতে পারে বলে পুলিশের একটি সূত্রের খবর।

শহরে দ্বিতীয় দফা ভোটের দিন, ৩০ এপ্রিল নেমেছিল কলকাতা পুলিশের ‘এলিট ফোর্স’-এর ১০০ জন। কমান্ডোর ৩০ আর স্পেশ্যাল অপারেশন গ্রুপ বা এসওজি-র ৭০ জন। ভোটে কখনও এমনটা হয়নি। কোনও দিন এলিট ফোর্স নামেনি বলে জানাচ্ছে লালবাজার।

Advertisement

যখন ওই সিদ্ধান্ত হয়, নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে তখন রাজীব কুমারকে সরিয়ে কলকাতার পুলিশ কমিশনার করা হয় সৌমেন মিত্রকে। ভোটে জিতেই রাজীব কুমারকে তাঁর পুরনো পদে ফিরিয়ে আনেন মমতা। তার পরেই রাজীববাবুর কাছে এই প্রশ্ন তোলেন লালবাজারের কর্তারা।

লালবাজারের এক কর্তার প্রশ্ন, ‘‘নির্বাচন কমিশন কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করতে বললে কি কোবরা, এনএসজি, মার্কোসদের নামানো হয়? তা হলে আমাদের কম্যান্ডো আর স্পেশ্যাল অপারেশন গ্রুপকে নামানোর কী
দরকার ছিল?’’

সেই সময়ে নির্বাচন কমিশনের হস্তক্ষেপে লালবাজারে ৩৯ দিনের যে জমানা রাজ করছিল, নজিরবিহীন এই সিদ্ধান্ত তাদেরই। যে নির্দেশ হাতে পেয়ে অবাক হয়ে যান কলকাতা পুলিশের কর্তাদের একাংশ। এ সিদ্ধান্ত অপছন্দ হওয়ার গুঞ্জন ছিল তখন থেকেই। কিন্তু সে সময়ে সরাসরি কোনও প্রশ্ন ওঠেনি।

ভোটপর্ব তখনও পুরোপুরি মেটেনি। কলকাতা পুলিশের শীর্ষ মহল ভোটে ‘অতি সক্রিয়তা’ দেখিয়ে ঠিক করেনি বলে ঠারেঠোরে নির্বাচনী সভায় দাঁড়িয়ে জানিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে পুলিশের ওই আচরণকে কোনও কোনও মহল, এমনকী ভোটারদের একাংশও পুলিশের ‘সাহস’ বা ‘শিরদাঁড়া’ বলে গণ্য করেছিল। মমতা দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় ফিরেই ‘সাহস দেখানো’, তদানীন্তন পুলিশ কমিশনার সৌমেন মিত্র ও আরও কয়েক জন আইপিএস অফিসারকে তুলনায় কম গুরুত্বের পদে বদলি করেছেন। জমানা বদলের পরে এ বার শিরদাঁড়া পর্বের ওই নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত নিয়েও প্রশ্ন উঠে গেল পুলিশের অন্দরেই।

কলকাতা পুলিশে আছে ৯০ জনের কম্যান্ডো বাহিনী ও ৭০ জনের এসওজি। জঙ্গি বা সন্ত্রাসবাদী দমনে এরা বিশেষজ্ঞ বাহিনী হিসেবে চিহ্নিত। এদের প্রশিক্ষণ, নিয়মিত অনুশীলন সে কথা মাথায় রেখেই।

কলকাতায় এখনও এমন কোনও জঙ্গি হামলা হয়নি যে, ওই বাহিনীকে কাজে লাগানো হবে। দক্ষতার ইস্পাতে মরচে যাতে না ধরে, সেই জন্য তাদের জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের বিরুদ্ধে অভিযানে পাঠানো হয়েছে। আবার আমরি হাসপাতাল অগ্নিকাণ্ডে ৩৯ জন ও স্টিফেন কোর্টের আগুন থেকে ৩২ জনকে উদ্ধার করেছিল কলকাতা পুলিশের ‘এলিট ফোর্স’। ২০০৭-এর নভেম্বরে পার্ক সার্কাস এলাকায় অশান্তির সময়েও কম্যান্ডো নেমেছিল। কিন্তু এ বার ভোটে তাদের মোতায়েন করার যুক্তি কী?

লালবাজার সূত্রের খবর, ৩০ এপ্রিল কলকাতায় দ্বিতীয় তথা শেষ দফা ভোটের দিন কয়েকটি তল্লাটে ব্যাপক হিংসা হতে পারে বলে খবর ছিল। আর সেই জন্য লালবাজারের একেবারে শীর্ষ মহল থেকে নির্দেশ যায়, এলিট ফোর্স-এর অন্তত ১০০ জনকে মোতায়েন করতে হবে। মূলত বন্দর, যাদবপুর ও টালিগঞ্জ— এই তিনটি বিধানসভা কেন্দ্রেই ওই বাহিনী মোতায়েন করা হয়। এর পিছনে যুক্তি ছিল, গোলমাল করার অভিষন্ধি নিয়ে থাকা লোকজন কালো পোশাক পরা কম্যান্ডোদের দেখে এতটা ভয় পেয়ে যাবে যে, বেচাল করারই সাহস পাবে না। আর গণ্ডগোল সত্যিই বাধলে অসীম শক্তিধর কম্যান্ডোরা খালি হাতেই পরিস্থিতির মোকাবিলা করবেন।

কিন্তু পুলিশেরই একটি মহল, এই সিদ্ধান্তকে অতি সক্রিয়তা বা বাড়াবাড়ি বলছে। তাদের মতে, এই বিশেষ বাহিনীকে ভোটের দায়িত্ব বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ন্যূনতম প্রশিক্ষণও দেওয়া হয় না। সে ক্ষেত্রে ওই কাজ করতে গিয়ে হিতে বিপরীত হলে তার দায় কে নিত? এই বাহিনীকে সযত্নে আগলে রাখতে হয়। যাতে চরম সঙ্কটে ওই বাহিনীর সদস্যেরা নিজেদের সেরাটা উজাড় করে দিতে পারেন শহরের সুরক্ষায়। ভোটে তাঁদের মোতায়েন করাটা এক ধরনের শক্তির অপচয়
বলে গণ্য করছে লালবাজারের কর্তাদেরই একাংশ।

এক পুলিশকর্তার কথায়, ‘‘১০০ জ্বর উঠতে পারল না, তার আগেই শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হল রোগীকে।’’ আর এক কর্তা বলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করতে বললে সিআরপি, বিএসএফ, সিআইএসএফ আসে। কোবরা, গ্রে হাউন্ড আসে না। এলিট ফোর্সকে নামানো গ্যালারিকে দেখাতে। র‌্যাফ, কমব্যাটই যথেষ্ট ছিল।’’

তবে কেউ কেউ মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ২০১৪-তে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ হটাতে এসওজি-রই একদল হামলে পড়েছিল ছাত্রছাত্রীদের উপরে। কাজেই বিশেষ বাহিনীর ‘শক্তির অপচয়’ শুধু ভোটের ডিউটি করানোর মাধ্যমে হয়েছিল, এমনটা নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন