বোমার উপরেই বাস করছি আমরা, ফুঁসে উঠল পাড়া

বৃদ্ধের মুখে কথা ফুটল না। গায়ে হাত দিয়ে এর পরে সামান্য ঠেলতেই মাটিতে পড়ে গেলেন তিনি। ধরাধরি করে তাঁকে ভ্যানে তোলার সময়ে দু’কান চেপে ধরে চেঁচাতে শুরু করলেন, ‘‘শুনতে পাচ্ছি না! বাঁচাও, বাঁচাও!’’

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০১৮ ০৩:২১
Share:

মর্মান্তিক: বিস্ফোরণের পরে ঘটনাস্থল। মঙ্গলবার, দমদম কাজিপাড়ায়। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য

গোটা এলাকা কয়েক মুহূর্তের জন্য একেবারে নিশ্চুপ। যেন যুদ্ধ শেষের নীরবতা! এক নম্বর কবি নবীন সেন রোডের ফুটপাতে তখনও থম মেরে বসে রয়েছেন হারাধন সরকার। পরনের হলুদ শার্টের সব ক’টি বোতাম ছিঁড়ে গিয়েছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে আশপাশ। শারীরিক প্রতিবন্ধী হারাধনবাবুকে কয়েক জন যুবক বললেন, ‘‘ঠিক আছেন? চলুন ভ্যানে উঠুন। হাসপাতালে যেতে হবে।’’

Advertisement

বৃদ্ধের মুখে কথা ফুটল না। গায়ে হাত দিয়ে এর পরে সামান্য ঠেলতেই মাটিতে পড়ে গেলেন তিনি। ধরাধরি করে তাঁকে ভ্যানে তোলার সময়ে দু’কান চেপে ধরে চেঁচাতে শুরু করলেন, ‘‘শুনতে পাচ্ছি না! বাঁচাও, বাঁচাও!’’ কোনও মতে তাঁকে ভ্যানে তুলে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

মঙ্গলবার গাঁধী জয়ন্তীর সকালে দমদম কাজিপাড়ায় বোমা বিস্ফোরণের অভিঘাত এমনই ছিল যে, বেলা পেরোলেও মুখে রা কাড়তে পারছেন না স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেই। বিস্ফোরণটি হয় কবি নবীন সেন রোডের একটি আবাসনের নীচে, মিষ্টির দোকানের সামনে। পাশেই ওই মিষ্টির দোকানের গুদামঘর। সামনেই ফল নিয়ে বসেন এক ব্যবসায়ী। পাশে রুটির দোকান। হঠাৎ বিস্ফোরণে হতভম্ব সকলেই। রাত পর্যন্ত এই ঘটনায় আট বছরের এক বালকের মৃত্যু হয়েছে। আহত অন্তত ১০ জন।

Advertisement

ওই আবাসন সংলগ্ন আর একটি ফ্ল্যাটবাড়ির বাসিন্দা সঞ্জয় সাউ জানান, সকাল পৌনে ন’টা নাগাদ ফ্ল্যাটের বারান্দায় বসে ছিলেন
তিনি। হঠাৎ প্রবল বিস্ফোরণের শব্দ। পরের কয়েক মিনিট কিছুই শুনতে পাননি। বারান্দা থেকে দেখেন, পাশের আবাসনের নীচে লোকজন লুটিয়ে পড়েছেন। মুহূর্তে ধোঁয়ায় ভরে যায় এলাকা। ভেঙে পড়ে আশপাশের বাড়ির জানলার কাচ। সঞ্জয়বাবু বলেন, ‘‘বেশ কিছু ক্ষণ হতভম্বের মতো বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। কানে তালা লেগে গিয়েছিল। পা-ও নড়ছিল না। নীচে লোকজন পড়ে ছটফট করছে। মনে হচ্ছিল, টিভিতে দেখা পরমাণু বিস্ফোরণের মতো কিছু হল।’’

কৌশী ভট্টাচার্য নামে আর এক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, ‘‘বারান্দা থেকে মুখ বাড়িয়ে দেখি, এক মহিলা
রাস্তায় থম মেরে বসে। তাঁর শরীর যে জ্বলছে, খেয়ালই নেই। আমাদের বিছানার চাদর মুড়িয়েই মহিলাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।’’ একই অভিজ্ঞতা বয়স্ক দম্পতি সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর স্ত্রী কল্পনার। দু’জনেই সত্তরোর্ধ্ব। বললেন, ‘‘এই বাড়িতে আমরা দু’জনেই থাকি। মনে হল, যেন মারাত্মক কিছু আকাশ থেকে নেমে এসেছে! বহু ক্ষণ কানে কিছু শুনতে পাইনি। বারান্দায় গিয়ে মুখ বাড়ানোর সাহসটাই ছিল না!’’

বিস্ফোরণের তীব্রতা এতটাই বেশি ছিল যে, ওই মিষ্টির দোকানের গুদামঘরের শাটারও দুমড়ে ভিতরে ঢুকে গিয়েছে। ভেঙে পড়েছে আবাসনের বাইরের দিকের
জলের পাইপ ও চুন-সুরকি। বিস্ফোরণস্থল সংলগ্ন ওই আবাসন এবং তার আশপাশের আবাসনগুলির তিনতলা পর্যন্ত জানলার কাচ ভেঙে যায়। খুলে যায় আলমারির পাল্লা। ভিতরে কাচের জিনিসপত্রও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মিষ্টির দোকানটিরও কাচ ভেঙে গিয়েছে বিস্ফোরণে। তার মধ্যেই থরে থরে সাজানো হরেক রকমের মিষ্টি।

বেলা বাড়তেই ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের তরফে এলাকা ঘিরে দেওয়া হয়। পুলিশ আধিকারিকদের পাশাপাশি এলাকার দখল নেন
বিভিন্ন তদন্তকারী সংস্থার আধিকারিকেরাও। ঘটনাস্থলে আসেন সিআইডি-র বম্ব ডিসপোজাল স্কোয়াডের সদস্যেরা। ঘটনাস্থল সংলগ্ন আবাসনের একাংশে দক্ষিণ দমদম পুরসভার চেয়ারম্যান পাচু রায়ের অফিস। সপ্তাহে তিন দিন তিনি ওখানেই বসেন বলে দাবি পাচুবাবুর। ঘটনার পরেই এলাকা পরিদর্শনে যান সুজিত বসু, পূর্ণেন্দু বসু, দোলা সেন, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক-সহ তৃণমূল নেতৃত্বের বড় অংশ। জ্যোতিপ্রিয়বাবু-সহ বাকিরা এই ঘটনার দায়
বিজেপি-র উপরে চাপাতে চাইলেও তদন্তের আগেই সে ভাবে কিছু বলতে নারাজ সুজিতবাবু।

বিস্ফোরণ ঘিরে দাবি ও পাল্টা দাবির মধ্যেই তখন একে একে আসছে আহতদের খবর। বেশির ভাগ স্থানীয় বাসিন্দারই অভিযোগ, হাসপাতালে চিকিৎসা হচ্ছে না! তাঁদের শান্ত করার যথাসম্ভব চেষ্টা করলেন নেতা-মন্ত্রীরা। খবর আসে, আট বছরের জখম বালকের মৃত্যু হয়েছে!

ভিড়ের মধ্যে থেকে এক জন বললেন, ‘‘বোমার উপরেই বাস করছি আমরা। না হলে পুজোর আগে বাচ্চাটা এ ভাবে মরবে কেন?’’

উত্তরে সত্যিই রা কাড়তে পারলেন না কেউ!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন