আসানসোলের বরাকরে একটি সভায় গান গাইছেন বাবুল। ফাইল চিত্র
সেকালে সুকুমার রায়ের ভীষ্মলোচন শর্মা গ্রীষ্মকালে গান জুড়েছিলেন। এই গ্রীষ্মে অনেক শর্মার গানই ভোট-প্রচারের উত্তাপ বাড়াচ্ছে। তাঁদের গান দিল্লি থেকে বর্মা পর্যন্ত ছড়িয়ে না গেলেও, দিল্লি-বঙ্গের ভোট-রাজনীতিকে যে এক সুতোয় বাঁধছে, তা মানছেন অনেকেই।
ভোটের গান নতুন কোনও বিষয় নয়। তবে তার আঙ্গিক এবং প্রকৃতি বদলেছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। এখন ভোট-প্রচারের অন্যতম অঙ্গ গান। মিউজিক-ভিডিয়োর আদলে তা বৈদ্যুতিন মাধ্যমে শ্রোতাদের উপরে বাড়তি প্রভাব ফেলে বলে মনে করছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল।
হালে গান বেঁধে রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়িয়েছেন আসানসোল কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী বাবুল সুপ্রিয়। সেই গানের মাধ্যমে বঙ্গের শাসক দলের বিরুদ্ধে শানানো ধারালো আক্রমণ প্রচারের আলো পেয়েছে যথেষ্টই। খানিকটা দক্ষিণী ঘেঁষা সুর-ঝঙ্কারের আবহে গায়ক-রাজনীতিকের বাঁধা সেই গান অবশ্য থামিয়ে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এখন তা বাজানো না হলেও, ইদানীং বিজেপির বিভিন্ন প্রচার সভায় সেই গান থেকে বাছাই করে তুলে আনা ‘...আর না’ শব্দগুচ্ছের ব্যবহার চলছে দেদার। যদিও ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বামেদের বিরুদ্ধে প্রচারে তৃণমূলের গান ছিল ‘অনেক হয়েছে আর না’। পরে বামেদের একটি মিছিলে সুরেলা ‘আর না’ প্রচারে ঝড় তুলেছিল। এই ভোটে সেই ‘আর না’ ফিরে এসেছে বাবুলের গানে।
পাল্টা হিসেবে শৈশবের দূরদর্শনের স্মৃতি উস্কে দেওয়া ‘মিলে সুর মেরা তুমহারা’-র প্রভাবিত সুরও এখন চৌকিদারি করতে আসরে নেমেছে। রাজনীতির ময়দানে অন্যতম আলোচ্য ‘চৌকিদার’ শব্দবন্ধের বিরুদ্ধে একরাশ ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ এবং সমালোচনা উগরে গান বলছে, ‘চুরি হয় তোমার ও আমার, টাকা মেরেছে চৌকিদার’। নেট-দুনিয়ায় তা ছড়াচ্ছে তড়িৎ গতিতে। রাজনীতি সচেতন নাগরিকদের বুঝে নিতে বেগ পেতে হবে না, গানটি কোন রাজনৈতিক শিবিরের ছত্রচ্ছায়ায় রয়েছে।
ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের বদলে বামেরা অবশ্য গান বেঁধেছে বিপ্লবকে সঙ্গী করে। যাদবপুর কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যের সমর্থনে রূপঙ্করের গাওয়া গান জানান দিচ্ছে, ‘পথের দাবি পথেই রাখা/পথেই দেখা হবে, বন্ধু তোমার স্বপ্ন বাঁচুক/আগামীর বিপ্লবে।’
সাম্প্রতিক প্রকাশিত একটি গান আবার তৃণমূলের অবস্থানকে স্পষ্ট করেছে। গানের কথায় রয়েছে, ‘বাংলার সাংস্কৃতিক ধারা, ধর্মনিরপেক্ষ চেহারা। সারা দেশকে দিয়েছে নাড়া, আমাদের মা-মাটি-মানুষ। ....দূর হটো দাঙ্গাবাজ যারা।’ শিল্পী রূপম ইসলামের কথায় ও সুরে এই গানটি গ্রহণ করেছে তৃণমূল। রূপমের সঙ্গে গানটি গেয়েছেন সোমলতা। রূপমের কথায়, ‘‘আমি আরও গান তৈরি করেছি। কার জন্য, কে নেবে বলছি না। এই গানটি মুখ্যমন্ত্রী নিজে পছন্দ করেছেন।’’ এরই পাশাপাশি নেট-দুনিয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে একাধিক গান, যা তৃণমূলের বক্তব্যেরই ধারক-বাহক। যুব সম্প্রদায়কে আকৃষ্ট করতে ‘র্যাপ’ ঘরানা, ভজগৌরাঙ্গের সুর এবং ‘আহা বেশ বেশ বেশ’-এর প্রভাবে তৈরি হয়েছে গানগুলি।
গবেষকেরা জানাচ্ছেন, এই সংস্কৃতি কম-বেশি ৬৭ বছরের পুরনো। ১৯৫২ সালে প্রথম লোকসভা নির্বাচনের সময় থেকে এই সাংস্কৃতিক উপচার ব্যবহৃত হয়ে আসছে। প্রধানত বামপন্থীদের হাত ধরেই জনপ্রিয় হয় ভোটকেন্দ্রিক এই সংস্কৃতিচর্চা। একটা সময় সামাজিক প্রেক্ষাপটে, সর্বোপরি মানুষের মনের ক্ষোভ-দুঃখ-দাবি তুলে ধরতে নাটক হয়ে উঠেছিল অন্যতম হাতিয়ার। ‘কালো হাত’, খাদ্য আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া হীরেন ভট্টাচার্যের ‘বাস্তব শাস্ত্র’, উৎপল দত্তের ‘স্পেশ্যাল ট্রেন’ নাটকগুলি জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠেছিল। পাশাপাশি, ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে বামপন্থীদের গণনাট্য সঙ্ঘ পরিবেশিত পথনাটিকা, নাটক এবং গানগুলিও বিপুল সাড়া ফেলেছিল। দাদাঠাকুরের ভোটের গান ‘আয় ভোটার আয়, ভোট দিয়ে যা’ জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠেছিল। কিছুর বিনিময়ে ভোট চাওয়ার প্রবণতা ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল গানটির মাধ্যমে।
গণনাট্য সঙ্ঘের দাবি, নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি আরএসএস-এর অন্তর্বর্তী রিপোর্টে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছিল, এই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড জনমানসে বিশেষ প্রভাব ফেলতে সক্ষম। ২০০৯, ২০১১ সালের নির্বাচনে অধুনা শাসক দল তৃণমূলও প্রচারের এই ঘরানাকে ব্যবহার করে ব্যাপক ভাবে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজেপিও নিজেদের প্রচারে এই সংস্কৃতির ব্যবহার করেছিল। অতীতে বামেদের বড় কোনও সমাবেশের শুরুতে গণনাট্য সঙ্ঘের সাংস্কৃতিক উপস্থাপনা গুরুত্ব পেত। পরবর্তী সময়ে তৃণমূলের বিভিন্ন বড় সভার শুরুতেও সাংস্কৃতিক উপস্থাপনা মানুষের নজর কেড়েছে।
তবে ২০১৯-এর নির্বাচনে রাজনৈতিক ভেদাভেদ, বৈরিতা ছাপিয়ে সব দলের ভোটকেন্দ্রিক প্রচারে সংস্কৃতিচর্চা যে অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে, সন্দেহ নেই। অতীতের মতোই যাতে রাজনৈতিক ব্যঙ্গ, কৌতুক, সামাজিক বার্তার উপাদান রয়েছে পূর্ণ মাত্রায়।