সব দলের রাজনৈতিক নেতাই তাঁদের কাছে আসেন। কিন্তু তাঁরা রাজনীতির সঙ্গে কোনও সংস্রব রাখেন না। কারণ, তাঁরা কোনও রকমের ‘পক্ষপাতিত্বে’ বিশ্বাসী নন।
এমন প্রথা চলে আসছে বহু যুগ ধরে। রাজনীতি থেকে দূরে থাকার এই পরম্পরা প্রায় ১২২ বছর ধরে মেনে চলছেন রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সন্ন্যাসী এবং ব্রহ্মচারীরা। শুধু এ রাজ্যে নয়, সারা দেশ জুড়েই বহু বছর ধরে চলে আসছে এই ধারাবাহিকতা।
সঙ্ঘের এক প্রবীণ সন্ন্যাসীর কথায়, ‘‘সারা পৃথিবীতে সমস্ত সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে রামকৃষ্ণ মিশনই সম্ভবত একমাত্র ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, যার সন্ন্যাসীরা নির্বাচনপর্বে কোনও ভাবেই অংশগ্রহণ করেন না।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘ভোট দিলে তো কোনও একটি দল কিংবা কোনও এক ব্যক্তিকে পছন্দ করতে হবে। আবার ‘নোটা’য় ভোট দিলেও তো কাউকে পছন্দ নয়, সেটা বলা হবে। এই সব কিছুই এক ধরনের পক্ষপাতিত্ব। আর সেটা কখনওই সন্ন্যাসীরা করতে পারেন না।’’
প্রবীণ সন্ন্যাসীরা জানান, স্বামী বিবেকানন্দের সময়কালটা ছিল পরাধীন ভারতবর্ষ। সেই সময়ে ভোটাধিকারের বিষয় না থাকলেও তখনই স্বামীজি বলে গিয়েছিলেন, রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের কোনও সন্ন্যাসী কখনওই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকবেন না। সেই কথা মেনেই নির্বাচনপর্বে অংশ নেন না এখানকার সন্ন্যাসীরা। এক প্রবীণ সন্ন্যাসী বলেন, ‘‘ভগিনী নিবেদিতা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গেই ছিলেন। কিন্তু জীবনের শেষ দিকে তিনি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় প্রথাগত ভাবে আর রামকৃষ্ণ মিশনের সদস্য ছিলেন না।’’
রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন অরাজনৈতিক সংগঠন হলেও প্রতিটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গেই তাদের সুসম্পর্ক রয়েছে। কারণ, রামকৃষ্ণ মিশন সকলকে নিয়ে চলতেই পছন্দ করে। আর তাই সেখানে কোনও প্রকার রাজনীতির স্থান নেই বলেই দাবি সঙ্ঘের প্রবীণ সন্ন্যাসীদের। এক প্রবীণ সন্ন্যাসীর কথায়, ‘‘সব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরাই আমাদের এখানে আসেন। যাঁরা ধর্ম মানেন না, তাঁরাও আসেন। আবার যাঁরা ধর্ম মানেন, কিন্তু আমাদের সর্বধর্ম সমভাবকে গ্রহণ ও অনুধাবন করতে পারেন না, তাঁরাও আসেন। আমরা কারও পৃষ্ঠপোষক নই।
আমাদের সঙ্ঘ সর্বধর্ম সমন্বয়ের পীঠস্থান। তাই সকলের জন্যই অবারিত দ্বার।’’ তবে রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ আছে। তাই রাজনীতিকদের মধ্যে যাঁরা সাংবিধানিক পদে (রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী ইত্যাদি) থাকেন, তাঁদের মঠ ও মিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়।
রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে সঙ্ঘের সম্পর্কটা বহু বছরের। রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের সন্ন্যাসীরা জানান, মহাত্মা গাঁধীও দু’বার বেলুড় মঠে এসেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে দেখা করতে। এক সময়ে যুবক সুভাষচন্দ্র বসুও সঙ্ঘের ভুবনেশ্বর কেন্দ্রে গিয়েছিলেন সন্ন্যাস নেওয়ার জন্য। কিন্তু তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন সঙ্ঘের প্রথম অধ্যক্ষ স্বামী ব্রহ্মানন্দ। নেতাজিকে তিনি বলেছিলেন, ‘তুমি দেশের কাজ করো।’ সুভাষচন্দ্র বেলুড় মঠেও এসেছিলেন। পরবর্তী সময়ে বালগঙ্গাধর তিলক, জওহরলাল নেহরু, চিত্তরঞ্জন দাশ, ইন্দিরা গাঁধী থেকে শুরু করে রাজীব গাঁধী, অটলবিহারী বাজপেয়ী, এ পি জে আবদুল কালাম, লালকৃষ্ণ আডবাণী-সহ আরও অনেকে এসেছেন বেলুড় মঠে।
প্রণব মুখোপাধ্যায়ও রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন জমা দেওয়ার আগে এসেছিলেন আশীর্বাদ নিতে। বেলুড় মঠের প্রবীণ সন্ন্যাসীরা জানাচ্ছেন, তালিকার শেষ এখানেই নয়।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী থেকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো রয়েছেনই। এমনকি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বহু শীর্ষ নেতৃত্বেরই আসা-যাওয়া রয়েছে রামকৃষ্ণ মিশনে। তবে যত বড় মাপের নেতাই আসুন না কেন, সকলের সঙ্গেই রাজনীতির বাইরের কথা হয় বলে জানাচ্ছেন সন্ন্যাসীরা।
বেশ কয়েক দিন আগে দেশের এক শীর্ষ নেতা বেলুড় মঠে এসে এক রাত কাটিয়েছিলেন। ‘‘তাঁকে বলা হয়েছিল, রাজনীতি নয়। তিনি চাইলে অদ্বৈত বেদান্ত নিয়ে আলোচনা হতে পারে,’’ বললেন এক সন্ন্যাসী।
বামফ্রন্টের আমলে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ও মন্ত্রী বিনয় চৌধুরী বেলুড় মঠে আসতেন বলে মঠ সূত্রের খবর। তবে মঠ ও মিশন চত্বরে দলীয় পতাকা নিয়ে ঢোকা ও রাজনৈতিক স্লোগান দেওয়া নিষিদ্ধ।
সন্ন্যাসীদের কথায়, ‘‘আসলে স্বামী বিবেকানন্দ সকলের। সমস্ত রাজনৈতিক দলই আজ তাঁকে নিয়ে শোভাযাত্রা করছে। অ-হিন্দু সম্প্রদায়ের মিছিলেও দেখা গিয়েছে শ্রীরামকৃষ্ণ, মা সারদা ও স্বামীজির ছবি। অলিখিত ধর্মগুরুরাও আজ বিবেকানন্দের কথা বলছেন। কারণ, স্বামীজি সর্বধর্ম সমন্বয়ের কথা বলেছিলেন। আর সেই সমন্বয় ব্যক্তি, সমাজ, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে।’’
তাই ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে সকলে তাঁদের কাছে এলেও তাতে রাজনীতি ও নির্বাচনের কোনও ছোঁয়া নেই বলেই জানাচ্ছেন রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের সন্ন্যাসীরা।