‘নিথর’ দু’বছর, তরুণীর ঠিকানা হাসপাতালই

বছর তেত্রিশের রাজশ্রী কুণ্ডু ও তাঁর স্বামী অর্ণব মুখোপাধ্যায় দু’জনেই দাঁতের ডাক্তার। বাড়ি মালদহ শহরে। মালদহের সেই পসার, রেলের চাকরি ছেড়ে অসুস্থ স্ত্রীর জন্য এখন মাসে প্রায় ২০ দিন কলকাতায় পড়ে থাকছেন অর্ণব।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৮ ০২:৩৭
Share:

রাজশ্রী কুণ্ডু (বাঁ দিকে)। হাসপাতালে এখন (ডান দিকে)। নিজস্ব চিত্র

জড় পদার্থের মতো হাসপাতালে পড়ে রয়েছেন রাজশ্রী। কথা বলতে পারেন না, হাত-পা নাড়তে পারেন না। দৃষ্টিশক্তি নেই। সন্দেহ, শ্রবণশক্তিও নেই। সচল শুধু হৃৎপিণ্ড। চোখের পলক পড়ে। এক দিন, দু’দিন নয়— এ ভাবে কেটে গিয়েছে ২ বছর ২২ দিন।

Advertisement

বছর তেত্রিশের রাজশ্রী কুণ্ডু ও তাঁর স্বামী অর্ণব মুখোপাধ্যায় দু’জনেই দাঁতের ডাক্তার। বাড়ি মালদহ শহরে। মালদহের সেই পসার, রেলের চাকরি ছেড়ে অসুস্থ স্ত্রীর জন্য এখন মাসে প্রায় ২০ দিন কলকাতায় পড়ে থাকছেন অর্ণব। রাজশ্রীর বাবা-মা রতন ও ছায়া কুণ্ডু জলপাইগুড়ির মালবাজারের বাড়ি ছেড়ে বেহালায় ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছেন। গত দু’বছর ধরে প্রতি দিন সকাল ন’টায় স্বামী-স্ত্রী আলিপুরে হাসপাতালে যান। সারা দিন চুপ করে মেয়ের পাশে বসে থেকে সন্ধ্যায় বেহালা ফেরেন।

অর্ণব জানিয়েছেন, এই দু’বছরে এক বারও তিনি হাসপাতালের বিরুদ্ধে কোথাও লিখিত অভিযোগ করেননি। শুধু হাসপাতালকে চিঠি দিয়ে জানতে চাইছিলেন, রাজশ্রী কবে ভাল হবে। তাঁর কথায়, ‘‘আমার কাছ থেকে সময় চেয়ে নিচ্ছিল হাসপাতাল। বলছিল, ৬ মাস দেখুন, রাজশ্রী ঠিক হয়ে যাবে। এ ভাবে ২০১৬-র অক্টোবর থেকে, ৬ মাস-৬ মাস করে দু’বছর কেটে গিয়েছে।’’

Advertisement

এ বার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে অর্ণবের। চলতি বছরের ১২ অক্টোবর জাতীয় ক্রেতা সুরক্ষা কমিশনের কাছে হাসপাতাল এবং সেখানকার তিন চিকিৎসকের নামে অভিযোগ করে ৭ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়েছেন তিনি। অভিযোগ পেয়ে দিল্লি থেকে জাতীয় ক্রেতা সুরক্ষা কমিশনের প্রধান, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আর কে আগরওয়াল আজ, সোমবার কলকাতায় আসছেন বলে অর্ণব জানিয়েছেন। সে দিন শুনানি হবে। ডাকা হয়েছে

আলিপুরের অভিযুক্ত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকেও। অর্ণবের দাবি, দিল্লির এইমস এবং বেঙ্গালুরুর নিমহান্‌স-এর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিয়ে দল গঠন করে রাজশ্রীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হোক। এ ছাড়াও ১৫ নভেম্বর আলিপুর থানায় এবং ১৬ নভেম্বর রাজ্যের ক্লিনিক্যাল এস্টাবলিশমেন্ট রেগুলেটরি কমিশনের কাছেও হাসপাতালের নামে অভিযোগ জানিয়েছেন ওই চিকিৎসক।

আট বছর আগে এসএসকেএম হাসপাতালে এ ভাবেই ২৫ বছরের এক তরুণী অলিম্পিয়া চট্টোপাধ্যায়ের চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ তুলেছিলেন তাঁর আত্মীয়েরা। প্রায় দেড় বছর হাসপাতালে রাজশ্রীর মতোই নিথর হয়ে পড়েছিলেন অলিম্পিয়াও। বছর চারেক আগে তিনি মারা যান।

রাজশ্রীর ক্ষেত্রে ঠিক কী হয়েছিল?

সল্টলেকে এক আত্মীয়ের বাড়িতে বসে অর্ণব বলেন, ‘‘২০১৩ সালে আমাদের বিয়ে হয়। দু’জনেই মালদহে প্র্যাক্টিস করতে শুরু করি। আমি রেলে চাকরিও করছিলাম। ২০১৬-র জুলাইয়ে রাজশ্রীর শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। পরীক্ষা করে জানা যায়, ইউটেরাসে একটি ছোট টিউমার হয়েছে। কলকাতায় এসে ওই হাসপাতালের এক চিকিৎসককে দেখালে তিনি জানান, তাড়াহুড়োর দরকার নেই। অক্টোবরে পুজোর পরে আসুন, তখন অস্ত্রোপচার করা যাবে।’’

চিকিৎসকের কথা মতো, কালীপুজোর আগে ওই বছরের ২৭ অক্টোবর আলিপুরের হাসপাতালে ভর্তি করা হয় রাজশ্রীকে। অর্ণব বলেন, ‘‘আগের দিন রাজশ্রী চিলি চিকেন রেঁধে, কালীপুজোর জন্য বাজি কিনে রেখে গিয়েছিল।’’ ২৮ অক্টোবর অস্ত্রোপচারের পরে চিকিৎসক জানান, কোমায় চলে গিয়েছেন রাজশ্রী। চিকিৎসক স্বামী জানতে চান, ইউটেরাসের টিউমার অস্ত্রোপচারের সময়ে কী ভাবে রোগী কোমায় চলে যেতে পারে? তাঁর অভিযোগ, অ্যানাস্থেশিয়ার সময়ে চূড়ান্ত গাফিলতি হয়েছে।

অর্ণবের আরও অভিযোগ, হাসপাতাল আপ্রাণ চেষ্টা করে গিয়েছে অভিযুক্ত চিকিৎসকদের আড়াল করতে। এ-ও অভিযোগ, অস্ত্রোপচারের সময়ে ৪২ হাজার টাকা দেওয়া হয় স্বাস্থ্য বিমা থেকে। প্রায় তিন মাস পরে, ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে অর্ণবের কাছে ১৭ লক্ষ টাকার বিল পাঠায় হাসপাতাল। সেই টাকা দেননি তিনি। জানান, অস্ত্রোপচারের আগের অবস্থায় স্ত্রীকে ফিরে পেলে তবেই টাকা দেবেন। তার পর থেকে ওই হাসপাতাল কোনও টাকার দাবি করেনি বলে জানিয়েছেন অর্ণব।

বিষয়টি জাতীয় ক্রেতা সুরক্ষা কমিশন দেখছে, সেই কারণে বিচারাধীন বলে এ নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন