Coronavirus in Kolkata

বাইশ দিনের কোমার আঁধার পেরিয়ে নতুন জন্মের স্বাদ 

শুধু ভাইরাস নয়, তাকে ঘিরে অজস্র প্রতিকূলতা জয় করার কাহিনি এপ্রিলের ১০-১১ তারিখের একটা রাত এখনও দুঃস্বপ্নের মতো তাড়া করে অপরাজিতাদেবীকে।

Advertisement

ঋজু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ জুলাই ২০২০ ০৩:৪৯
Share:

ব্রতী: বাড়ি থেকেই মানুষের পাশে নিতাইদাস মুখোপাধ্যায়

‘আমি কোথায়?’

Advertisement

চোখ খুলে সামনে নীল পোশাক পরা এক মহিলাকে দেখে কোনও রকমে এটুকুই জানতে চেয়েছিলেন নিতাইদাস মুখোপাধ্যায়। শরীরে সীমাহীন ক্লান্তি, শব্দহীন গলায় ফুটো করে কী এক বিজাতীয় যন্ত্র বসানো। বিছানায় প্রায় মিশে থাকা অবস্থায় তাঁর মনে হচ্ছিল, কারা যেন আটকে রেখেছে তাঁকে। তবে ৫২ বছরের নিতাইবাবু এখন জানেন, কোমায় জীবনের ২২টা দিন মুছে গিয়েছে স্মৃতি থেকে। টানা ৩৮ দিন কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্রের সাহায্যে কাটানো এই কোভিড-জয়ী ডায়াবিটিসের রোগী, দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুসের অসুখেও ভুগছেন। এতগুলো দিন ভেন্টিলেটরে কাটিয়ে ফিরে আসার গল্প হাতে-গোনা। নিতাইবাবুর কাহিনিও তাই দেশ-বিদেশের সংবাদমাধ্যমে চর্চিত হয়েছে। কান ঘেঁষে যাওয়া মৃত্যুকে দূরে ঠেলে জীবনে ফিরে আসার এই জয়গাথা তাই শিশুর তিলে তিলে উঠে দাঁড়ানো, হাঁটতে শেখার মতোই রোমাঞ্চকর।

কলকাতার রাস্তায় হাঁটতে এখনও খানিক অসুবিধা হচ্ছে মুদিয়ালির বাসিন্দা, সমাজকর্মী নিতাইবাবুর। তবে টলমলে পায়ে হাঁটা ছাড়া ইতিমধ্যে তাঁর প্রিয় সঙ্গী অ্যাম্বুল্যান্স-কাম-রেসকিউ ভ্যানের স্টিয়ারিংয়ে দিব্যি বসতে পারছেন তিনি। গত ২৯ মার্চ থেকে ৮ মে ঢাকুরিয়ার একটি বেসরকারি হাসপাতালে কাটিয়ে ফিরেছেন নিতাইবাবু। স্ত্রী অপরাজিতাদেবীর কথায়, “তখনও ওঁর ঘাড়ের কাছটা সদ্যোজাত শিশুর মতোই নরম ছিল! নিজে নিজে বিছানায় পাশ ফিরতেও পারতেন না। কিন্তু অসম্ভব মনের জোর। বাড়ি ফেরার দিন কুড়ি পরে ওঁর প্রথম বার উঠে দাঁড়ানোর মুহূর্তটা কোনও দিন ভুলতে পারব না।” অথচ সেই নিতাইবাবু দু’দিন আগে গাড়ি চালিয়ে ১০ কিলোমিটার দূরে আনন্দপুরে তাঁর শ্বশুরবাড়িতেও ঘুরে এসেছেন।

Advertisement

এপ্রিলের ১০-১১ তারিখের একটা রাত এখনও দুঃস্বপ্নের মতো তাড়া করে অপরাজিতাদেবীকে। রাত ১১টা নাগাদ ডাক্তার শাশ্বতী সিংহ নিজেই ফোনে জানান, ‘পেশেন্টের প্রেশার অস্বাভাবিক নেমে গিয়েছে। খারাপ কিছু ঘটতে পারে।’ বাড়িতে শয্যা-বন্দি অশীতিপর শাশুড়িকে কিছু জানাতে পারেননি অপরাজিতাদেবী। শুধু মনে হয়েছিল, হয়তো স্বামীর সঙ্গে আর দেখা হল না! এর পরে ভোরের দিকে খবর আসে, রোগীর অবস্থা আগের থেকে ভাল।

ঢাকুরিয়ার ওই হাসপাতালে ভর্তির আগে, গাড়িতে ওঠার পরে আর বিশেষ কিছু মনে নেই নিতাইবাবুর। কিন্তু দীর্ঘ ঘুমের অন্ধকারের শেষে দু’-একটি স্মৃতি ভোলার নয়— ডাক্তার শাশ্বতীদেবী প্রথম যে দিন তাঁর মাথা ধুইয়ে, দাড়ি কেটে সাফসুতরো করে দিতে বললেন নার্সদের। “মণিপুরের মেয়ে এক জন নার্স আমার থুতনির কাছটা ধরে চুল আঁচড়ে দিয়েছিল। সে সময়ে মনে হচ্ছিল, ছোট্ট আমাকে তৈরি করে মা স্কুলে পাঠাচ্ছে। নতুন করে হাসপাতালে জন্মেছি। নার্স, আয়ারা প্রত্যেকেই আমার মা!” —বলছিলেন নিতাইবাবু। মাসখানেক পরে আইসোলেশন ওয়ার্ড থেকে সরানোর পরে এক দিন ভিডিয়ো কলে স্ত্রীর সঙ্গে নিতাইবাবুর কথা বলিয়ে দেন ডাক্তার। ‘এই তো তুমি ভাল হয়ে গিয়েছ’ বলা সে দিনের স্ত্রীর হাসিখুশি মুখটা আজও চোখে ভাসে নিতাইবাবুর। “সে দিন আমি ওঁকে বুঝতে দিইনি, মনের ভেতরে কী ঝড় বইছে।” —বলছেন অপরাজিতাদেবী।

করোনা পর্বে কলকাতায় বা দেশের প্রথম কয়েক জন রোগীর এক জন নিতাইবাবু। নিজের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কাজে গত আড়াই দশক ধরে শহরের রাস্তায় পরিত্যক্ত অসুস্থদের সেবা করছেন। যে কোনও বিপর্যয় মোকাবিলায় পৌঁছে যান। রাতের পর রাত জেগে প্রশাসনকে সাহায্য করেন। লকডাউন ঘোষণার পরেও গৃহবন্দি বয়স্কদের পরিচর্যায় জড়িয়েছিলেন। কিন্তু কাশি-জ্বর-শ্বাসকষ্টের ধাক্কা তাঁর জীবনটাকেই পাল্টে দিয়েছে পুরোপুরি। এখন বাড়ি থেকেই অন্যের পাশে সাধ্যমতো দাঁড়াচ্ছেন। বলছেন, “কিছু কাজ বাকি আছে বলেই ঈশ্বর ফিরিয়েছেন। এটা ভেবেই জোর পাচ্ছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন