বিধাননগর

বিজয়রথের সবুজ ধুলোয় আকাশ ঢাকল উপনগরীর

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে মার্জনা চেয়ে এটুকু বললে বোধহয় ভুল হয় না। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময়কার বিখ্যাত রবীন্দ্রগানের একটা ‘প্যারডি’ ইদানীং সোশ্যাল মিডিয়ায় চাউর হয়ে গিয়েছে। ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বুকে একটাই দল..!’ শনিবাসরীয় সকালে বিধাননগর গভর্নমেন্ট কলেজে গণনাকেন্দ্রের আশপাশের ছবিটা দেখলে এ হেন লিরিকই অব্যর্থ মনে হবে।

Advertisement

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০১৫ ০১:০৮
Share:

উৎসব। শনিবার, সল্টলেকে। ছবি: সুমন বল্লভ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে মার্জনা চেয়ে এটুকু বললে বোধহয় ভুল হয় না। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময়কার বিখ্যাত রবীন্দ্রগানের একটা ‘প্যারডি’ ইদানীং সোশ্যাল মিডিয়ায় চাউর হয়ে গিয়েছে। ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বুকে একটাই দল..!’ শনিবাসরীয় সকালে বিধাননগর গভর্নমেন্ট কলেজে গণনাকেন্দ্রের আশপাশের ছবিটা দেখলে এ হেন লিরিকই অব্যর্থ মনে হবে।
বাইরে ব্যারিকেডের উপরে আছড়ে পড়া সবুজ আবিরস্নাত জনতার কথা বাদ দিন। বেলা সাড়ে এগারোটার পর থেকেই গণনাকেন্দ্রে মিডিয়া সেন্টার কার্যত ‘তৃণমূল ভবন’ হয়ে উঠল। শুনতে ক্লিশে লাগতে পারে, আশপাশে সিপিএম, বিজেপি বা কংগ্রেস খুঁজতে সত্যিই অণুবীক্ষণ যন্ত্রে চোখ রাখতে হতো। গণনাকেন্দ্রের কাছেপিঠের কোনও গাছেও লাল ফুলটুল চোখে পড়ল না।
এমন সুখের দিনে বিধাননগরের মেয়র হওয়া নিয়ে আকচাআকচি অবধি ঢাকা দিতে সফল শাসক দলের দুই মহারথী। সব্যসাচী দত্ত এসে সপুত্র, সকন্যা উপস্থিত কৃষ্ণা চক্রবর্তীর পাশেই বসে পড়লেন। এই যুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সেনাপতি’ জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকও কাছেই বসে। সব্যসাচীর স্নেহধন্য শাহনওয়াজ আলি ওরফে ডাম্পি মণ্ডল, স্বাতী বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে সল্টলেক এলাকায় জয়ী তুলসী সিংহ রায়, অনিতা মণ্ডলরাও পাশাপাশি চেয়ারে গা এলিয়ে। হাতে-হাতে চিপসের প্যাকেট, নরম পানীয়।

Advertisement

হঠাৎ উঠে সব্যসাচী ‘কই আমার সোনা ছেলেমেয়ে দু’টো কই’ বলে এগিয়ে গেলেন। সকলে অবাক! ‘‘এই আমার দু’জন সব থেকে কম বয়সী ক্যান্ডিডেট! কী দারুণ মার্জিনে জিতেছে!’’— বলেই নিউ টাউনের সিন্ডিকেট-চাঁই সমীর সর্দার ওরফে ভজাইয়ের ‘সুপুত্র’ প্রসেনজিৎ সর্দার এবং এক নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী সুস্মিতা দাসের পিঠে হাত রাখলেন। ফটাফট ক্যামেরায় ছবি উঠল। ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে ২৫ বছর বয়সী প্রসেনজিৎ ৫২০০ ভোটে জিতেছেন। আর রাজারহাটের ডিরোজিও কলেজের বিএ প্রথম বর্ষ, ২২ বছরের সুস্মিতা সাড়ে তিন হাজারের বেশি ভোটে জয়ী।

খাতায়-কলমে সব ওয়ার্ডের ফল ঘোষণার আগেই বাইরের ব্যারিকেড খুলে দিয়েছিল পুলিশ। ‘‘আমি রিটায়ার্ড এসি অপূর্ব সোমচৌধুরীর বোন! সামনে ফাঁকা জায়গাটায় একটু নাচতে দিন!’’ বলে পুলিশকে সেধে পাগল করে দিচ্ছিলেন কেষ্টপুরের প্রৌঢ়া মায়া সিংহ। রাজারহাটের নূপুর দাস, রুমা কাহার, বৈশাখীর জয়া দাস, কৃষ্ণা বসু, দত্তাবাদের রিতা চাদ, সুলেখা মণ্ডলরাও ছুট্টে সামনে ‘পোজিশন’ নিলেন। দেদার চকলেট বোমা, ড্রাম, শাঁখ, কাঁসর, বাঙালি ভুভুজেলায় কার্যত উড়ে গেল শব্দবিধি। কাগজে-কলমে ‘বিজয়-মিছিল’ বলা না-হলেও ফেট্টি বাঁধা বাইকবাহিনীর চক্করও শুরু হয়ে গেল।

Advertisement

তৃণমূলময় সেই সবুজে সবুজ জগতের দিকে তাকিয়ে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বললেন, ‘‘কীসের বহিরাগত! সিপিএম, বিজেপি ও কংগ্রেসই এখানে বহিরাগত।’’ মুখ্যমন্ত্রীর সাধ মিটিয়ে ৪১-০ স্কোর করতে পারেননি, তবু জ্যোতিপ্রিয় নিজেকে ডিস্টিংশন-সমেত উত্তীর্ণ বলে মনে করছেন। বরং, তাঁর সুহৃদেরা চুপিচুপি বললেন, ‘‘বিরোধীরা চারটে আসন পেয়ে ভালই হয়েছে। নিন্দুকদের মুখ বন্ধ হবে।’’ সব্যসাচী দত্ত কিন্তু বেপরোয়া ভঙ্গিতে চ্যালেঞ্জ ছুড়লেন, ‘‘জিতেছে তো কী! দেখি, ক’দিন ও দিকে থাকতে পারে! শেষে আমাদের দিকেই আসতে হবে!’’

পাঞ্জাবির উপরে রজনীগন্ধার মালা চাপিয়ে ঘুরছেন সহাস্য সুধীরকুমার সাহা। ‘হাতি মেরে জিতেছেন!’ অসীম দাশগুপ্তকে হারানো প্রার্থীকে নিয়ে উচ্ছ্বাস! ‘‘কী, বলেছিলাম না সুধীরদা জিতবেন!’’, বলে তাঁর পেটে হাল্কা খোঁচা মারলেন আবিরে সবুজ দমদম পুরসভার চেয়ারম্যান পারিষদ রিঙ্কু দত্ত দে। বললেন, ‘‘৩২ আর ৪১, এই দু’টো ওয়ার্ড ওরা লিস্টের বাইরে রেখেছিল! দায়িত্ব পেয়ে আমি বলেছিলাম, জিতবই জিতব!’’

নির্দল প্রার্থী অনুপম দত্তের সঙ্গে টক্করে ভোটযন্ত্র খোলার সময়ে চাপে ছিলেন ৪১-এর প্রার্থী অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়। দেখা গেল, জিতেও ভোটের দিন ওয়ার্ডে মারপিটের অভিযোগ নিয়ে বিতর্ক ভুলতে পারেননি। ওই ওয়ার্ডেই নিগৃহীত প্রীতিকুমার সেনের প্রসঙ্গ উঠতে রাগটা বেরিয়ে এল। চার আঙুলের সোনার আংটি ঘুরিয়ে বললেন, ‘‘আমি ওকে বলেছিলাম, আজ আপনি হিরো ঠিকই, তবে ফল বেরোলে আপনিই হেরো হবেন!’’ কী ভাবে উৎসব হবে? শুনে এক পরিচিতকে চোখ টিপলেন, পিকচার আভি বাকি হ্যায়!

তবে সদ্য সিপিএম থেকে জার্সি বদলে তৃণমূল হয়েও বিপুল ভোটে জয়ী তাপস চট্টোপাধ্যায়কে শাসক দলের এই চাঁদের হাটে বেশি ক্ষণ দেখা গেল না। গণনাকেন্দ্র থেকে বেরোতে না-বেরোতেই তাঁর সাদা পাঞ্জাবি সবুজে ছয়লাপ। সব্যসাচী-ডাম্পিদের সংস্রব এড়িয়ে সটান অপেক্ষমান এসইউভি-তে উঠলেন তাপস।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement