সূচনা দেবীপক্ষের। একই সঙ্গে ফাইনাল কাউন্টডাউন শুরু উৎসব কাপেরও!
পাঁজি ধরে পুজোর শুরু হতে বাকি ছ’দিন। কিন্তু গত কয়েক বছরে উৎসবের বোধন হয়ে যায় চতুর্থীতেই। সেই লড়াইয়ে টেক্কা দিতে কোমর বেঁধেছে শহরের প্রথম সারির পুজোগুলিও। লড়াই অবশ্য শুধু তাদের নয়, লড়াই বড় পুজোর খেলোয়াড় থুড়ি শিল্পীদেরও। কার তৈরি মণ্ডপ দেখতে কত লোকের লাইন পড়বে, তা নিয়ে মনে মনে যথেষ্ট চাপে শহরের প্রথম সারির অনেক শিল্পীও।
গত কয়েক বছর ধরেই দক্ষিণ কলকাতার হিন্দুস্থান পার্ক সর্বজনীন ভিড় টানার লড়াইয়ে টেক্কা দিয়েছিল অনেককেই। পুজোর হাত ধরে সুনাম বাড়িয়েছেন বহু শিল্পীও। এ বার এই পুজোর ভার নিয়েছেন প্রশান্ত পাল। পুজো ময়দানের পরিচিত মুখেরা জানেন, শহরের শিল্পীদের মধ্যে প্রশান্ত প্রথম সারিতেই। তাঁর ডোকরার কাজ দেখতে দর্পনারায়ণ ঠাকুর স্ট্রিটে ভিড় উপচে পড়াও দেখেছে শহর। হিন্দুস্থান পার্কে তিনি তুলে ধরছেন ভক্তিভাব। মণ্ডপসজ্জায় মাটি, পটের পাশাপাশি লালপাড় শাড়ি, শাঁখা, সিঁদুরও ব্যবহার হচ্ছে।
ভিড়ে টেক্কা দিতে আস্তিন গুটিয়ে তৈরি হচ্ছে দক্ষিণের আর এক নামী পুজো শিবমন্দিরও। শিল্পী সুবোধ রায়ের হাত ধরে এ বার তাঁদের থিম ‘বাণিজ্যে বসতে বাংলা’। বাংলা ও বাঙালির ব্যবসার দুর্দিন নতুন কিছু নয়। কিন্তু এক সময়ে এই বাংলা থেকেই যে সপ্তডিঙা মধুকর জলে ভাসত, সেটাই উঠে আসছে শিবমন্দিরে। ভরদুপুরে সেখানে গেলেই দেখা যাবে, পুজোকর্তা পার্থ ঘোষ এক বার ছুটে যাচ্ছেন পুজো কমিটির অফিসঘরে। পরক্ষণেই আবার মণ্ডপের চূড়ান্ত পর্যায়ের কাজে তদারকিতে লেগে পড়ছেন। মণ্ডপে দাঁড়িয়েই বললেন, “এ বার পুজোয় অনেককেই টেক্কা দেব আমরা।”
চলতি শতকের শুরু থেকেই ধীরে ধীরে পুজো ময়দানে উপরের সারিতে উঠে এসেছিল বড়িশা ক্লাব। সেখানে কাজ করে বিখ্যাত হয়েছেন, এমন শিল্পীও নেহাত কম নন। লোকে বলে, পুজোর দিনগুলিতে বেহালামুখী লোকজনের অন্যতম গন্তব্য এই ক্লাবের পুজো। এ বারও উৎসবের কাপের লড়াইয়ে তোড়জোড় বেঁধেই নেমেছেন তাঁরা। শিল্পী প্রদীপ দাস সেখানে তুলে ধরছেন বাঙালির জীবনে দুধের ভূমিকাকে। হিন্দু ধর্মেও কামধেনুর গুরুত্ব রয়েছে। এ সব মিলিয়েই থিম সাজিয়েছেন প্রদীপ। বিভিন্ন যন্ত্রাংশ, সাইকেলের চেন এ সব মিলিয়েই গরু, মহাদেব, নানা দেবদেবীর মূর্তি তৈরি করেছেন তিনি। নতুন শিল্পীর এমন অভিনব কাজ নিয়ে যারপরনাই উত্তেজিত পুজোকর্তা অনিমেষ চক্রবর্তী। তিনি বলছেন, “চিরাচরিত থিমের বাইরে এসে এ বার নতুন ভাবনাতেই লোক টানব আমরা।” টানা কয়েক বছর কাজ করে দক্ষিণের ত্রিধারা সম্মিলনীর ঘরের ছেলে হয়ে উঠেছেন গৌরাঙ্গ কুইল্যাও। তাঁর হাত ধরেই ভিড় টানার লড়াইয়ে প্রথম দিকে থাকে ত্রিধারা।
উৎসব কাপের লড়াইয়ে উত্তর-দক্ষিণের লড়াইটা বহু পুরনো। থিম আসার পরে তা বেড়েছে বই কমেনি। কখনও উত্তরের ঘরের ছেলেকে তুলে নিয়েছে দক্ষিণের পুজো। যেমন হাতিবাগান নলিন সরকার স্ট্রিটের ঘরের ছেলে বলে পরিচিত সনাতন দিন্দা গত বছর থেকেই দক্ষিণে পাড়ি দিয়েছেন। এ বারে তিনি যোধপুর পার্ক ৯৫ পল্লির পাশাপাশি চেতলার একটি নামী পুজোতেও কাজ করছেন। নিউ আলিপুরের একটি নামী পুজোর ঘরের ছেলে সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় এ বারই প্রথম উত্তরে পা দিয়েছেন। হাতিবাগানের সিকদারবাগানে মাশরুম নিয়ে কাজ করছেন তিনি।
দক্ষিণে কাজ করলেও উত্তরের টালা বারোয়ারির ঘরের ছেলে হয়ে উঠেছেন শিল্পী অমর সরকার। এ বারে অ-সুর নিধনের থিম গড়েই টেক্কা দিতে চান তিনি। থিমের প্রচারে যথেষ্ট রহস্য রেখেছেন টালা বারোয়ারি। শেষ পর্যন্ত যে কী হবে, তা খোলসা করে বলতে চাইছেন না পুজোকর্তারা। উদ্যোক্তাদের অন্যতম অভিষেক ভট্টাচার্য বলছেন, “ওটাই তো আসল চমক।”
আহিরীটোলা সর্বজনীনের পুজোর এ বার ৭৫ বছর। চমক দিতে তারকা শিল্পীকেই দায়িত্ব দিয়েছেন তাঁরা। গত বছর শিল্পী ভবতোষ সুতারকে উত্তরে এনেছিল হাতিবাগান সিকদারবাগান। মন্ত্রী-সান্ত্রীদের পুজো সামলে এ বার ভবতোষ আহিরীটোলাতেও! সময়ের তালে তাল মিলিয়ে মানবসমাজ ও পুজোর পরিবর্তনকেই ধরতে চেয়েছেন তিনি। তাঁর ‘সিগনেচার’ প্রতিমার ঢঙেই তৈরি করছেন মূর্তি। সামান্য বদলও আছে। আহিরীটোলা সর্বজনীনের মণ্ডপে ঢুকে এক ঝলকে মনে হতেই পারে, দুর্গা এখানে অষ্টাদশভূজা! আবার দশভূজাও মনে হতে পারে! দমদম পার্ক তরুণ সঙ্ঘে শিল্পী প্রশান্ত পাল তুলে ধরছেন হরিয়ানার উৎসব। লালাবাগানে তিনিই আবার বাঁশ-মাটির ইনস্টলেশন নিয়ে কাজ করেছেন।
ময়দানে দুই প্রধানের লড়াইটা চেনা। সেই লড়াইয়ে হার আছে, জিত আছে। আছে ড্র-ও। পুজো ময়দানে কিন্তু প্রধানের সংখ্যা অনেক। এখানে হার-জিতের মানেটাও অন্য। আর ড্র?
নেই বললেই চলে।