চিকিৎসা হোক বা ভাল থাকা, হাত বাড়ালেই ‘বন্ধু’

রঙিন টিভিতে ধারাবাহিক এগিয়ে যেত। কিন্তু দু’চোখ তখন জানলার দিকে তাকিয়ে যেন কাউকে খুঁজত। একা একা বড় অসহায় লাগত।

Advertisement

তানিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০১৬ ০২:০০
Share:

রঙিন টিভিতে ধারাবাহিক এগিয়ে যেত। কিন্তু দু’চোখ তখন জানলার দিকে তাকিয়ে যেন কাউকে খুঁজত। একা একা বড় অসহায় লাগত। সন্ধেবেলার হাঁটতে যাওয়ার পালা তো কবেই চুকে গিয়েছিল বোসপুকুরের প্রশান্ত রায়ের। দিনের বেলাটা কোনও মতে কাটলেও, সূর্য ডোবার পরের সময়টা যেন কিছুতেই কাটতে চাইতো না। এক ‘ম্যাজিকে’ কিন্তু সেই সমস্ত সমস্যার অবসান হয়েছে।

Advertisement

জীবন সায়াহ্নে এসে ‘ভয় লাগে’ বলতে একটু লজ্জা হত প্রশান্তবাবুর। সুদূর আমেরিকা থেকে প্রতিদিন ফোন করতেন একমাত্র ছেলে প্রীতম রায়। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার প্রীতম নিজের দুই মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে বছর আটেক হল আমেরিকায় থাকেন। স্ত্রীর মৃত্যুর পরে একাকীত্ব আরও বেড়ে গিয়েছিল প্রশান্তবাবুর। নিজের বাড়ি, শহর ছেড়ে কোথাও যেতে রাজি নন। কিন্তু আশি বছরের এই অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক একা যে ভাল নেই, তা ফোনের ওপার থেকে টের পেতেন পুত্রবধূ। ভাবতেন, যদি কোনও কাছের মানুষ সব সময়ে ওঁর কাছে থাকেন যার চিকিৎসার নূন্যতম শিক্ষা রয়েছে আবার মন ভাল রাখার উপায়ও জানা, কতই না ভাল হত!

এই ‘ম্যাজিক’ খুঁজতে গিয়ে ক্লান্তি কয়েকগুণ বেড়ে যেত অস্ট্রেলিয়া নিবাসী শ্রেয়া বৈদ্যের। পেশায় প্রাণীবিদ্যার গবেষক শ্রেয়া বছর পাঁচেক ধরে প্রবাসে রয়েছেন। বিদেশে পাড়ি দেওয়ার বছর দুয়েক পরেই সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন তাঁর বাবা। এ দিকে নিজের কাজ ছেড়ে কলকাতায় আসার মতো পরিস্থিতিও নেই। সব মিলিয়ে ভীষণ সমস্যায় পড়েন শ্রেয়া। বারবার ইন্টারনেটে খুঁজতে থাকেন এমন কোনও সংস্থা, যারা বাড়িতে চিকিৎসা পরিষেবা দেবে এবং পাশে থেকে মায়ের মনোবল বাড়াবে। এমনকী রাতে দরকার হলে যারা অ্যাম্বুল্যান্স থেকে হাসপাতালে ভর্তি, ওষুধ কেনা— সবই করবেন বাড়ির সদস্যের মতো।

Advertisement

শ্রেয়া কিংবা প্রীতম কোনও ব্যতিক্রম নন। কাজের তাগিদে এখন ছেলেমেয়েরা পাড়ি দিচ্ছেন ভিন্‌ রাজ্যে বা বিদেশে। এ শহরে থাকছেন বয়স্ক মা-বাবা। শুধুই শারীরিক সমস্যা নয়, একা একা জীবনযাপন এই সব বয়স্ক মানুষদের নানা ধরনের মানসিক সমস্যা বাড়াচ্ছে। অসুখ হলে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া ও ওষুধ খাওয়াই নয়, নিত্যদিন তাঁদের যত্ন নেওয়ার লোকের বড়ই অভাব দেখা দিচ্ছে। সেই সব একা মানুষদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বেশ কয়েকটি সংস্থা। যারা স্বাস্থ্য পরিষেবার পাশাপাশি ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে ‘আত্মীয়-বন্ধু’-দের। বয়স্কদের কাছে ওই সংস্থার কর্মীরাই যেন জাদুকর। যাঁদের জাদুকাঠির ছোঁয়ায় পালিয়ে গিয়েছে সব ভয়, সব একা থাকা।

দক্ষিণ কলকাতায় এমনই একটি সংস্থা বাড়িতে স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছে দেয়। ডিমেনশিয়া-সহ একাধিক বার্ধক্যজনিত রোগের চিকিৎসার জন্য নিয়মিত সংস্থার সদস্যদের বাড়ি গিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন চিকিৎসক। তবে শুধু স্বাস্থ্য পরিষেবাই নয়, ‘প্যারা মেডিক্যাল’ এবং ‘নন মেডিক্যাল’ এই দুই পরিষেবা পৌঁছে দেয় এমন সংস্থাও রয়েছে এ শহরে। প্রবীণ নাগরিকদের বেশ কয়েকটি স্কিমের মাধ্যমে দেখভালের ব্যবস্থা রেখেছে যারা। এমনই একটি সংস্থার সিইও প্রতীপ সেন বললেন, ‘‘মেডিক্যাল এবং নন মেডিক্যাল উভয় দিকই আমরা দেখি। উভয়ক্ষে ত্রেই বাড়িতে পরিষেবা পৌঁছে দিই।’’

কী ধরনের নন চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া হয়? সংস্থার এক কর্তা জানান, অনেকেই শারীরিক দিক থেকে সুস্থ, কিন্তু একা থাকেন। একাকীত্ব তাঁদের মানসিক ভাবে দুর্বল করে তোলে। একা বাড়ি থেকে বেরোতে চান না। তাঁদের পেনশনের টাকা তুলতে ব্যাঙ্কে নিয়ে যাওয়া, গাড়ি করে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। প্রয়োজনে ব্যবস্থা করা হয় অ্যাম্বুল্যান্সেরও। সংস্থার এমন অনেক সদস্য রয়েছেন, যাঁরা রাত-দিনের জন্য কোনও ‘আত্মীয়’ চান না। এক সপ্তাহ অন্তর তাঁদের সঙ্গে দেখা করলেই হয়। কিন্তু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেলে কী হবে? সব সদস্যের হাতেই একটি ইলেকট্রিক ব্যান্ড বেঁধে দেওয়া হয়। তাঁদের শারীরিক অবস্থার অবনতি হলেই সেই ব্যান্ড সঙ্কেত দেবে। সংস্থার কর্মীরা হাজির হবেন তৎক্ষণাৎ। ‘প্যারা মেডিক্যাল’ পরিষেবার মধ্যে রয়েছে ফিজিও থেরাপি, সাইকো থেরাপিও। দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার জেরে অনেকেই মানসিক সমস্যায় ভোগেন। তাঁদের সম্পূর্ণ সুস্থ করতেই এই ব্যবস্থা রয়েছে।

এ ধরনের পরিষেবা পৌঁছে দেয় যে সব সংস্থা, তাদের কর্তারা জানাচ্ছেন, বিভিন্ন স্কিমের খরচ আলাদা। ২৫০ টাকা থেকে শুরু করে মাসিক ৩০০০ টাকা পর্যন্ত স্কিম রয়েছে। সদস্যেরা পছন্দ মতো বেছে নেন। এ ধরনের সংস্থাগুলিতে সদস্যের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। তাই তারা ক্রমে কলকাতার পাশাপাশি দুর্গাপুর, আসানসোলেও এই পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন