Coronavirus

পাল্টানো কফিহাউসে দেখা নেই ‘লাদেনদের’

তাঁদের চার হাত এক হলেও ফুরোয়নি কফিহাউসের আড্ডা। নিজেদের কফিহাউস পরিবারেরই অংশ বলে মনে করে এ দম্পতি।

Advertisement

ঋজু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ জুলাই ২০২০ ০৩:৪৯
Share:

পরীক্ষা: কফিহাউসে ঢোকার আগে চলছে থার্মাল স্ক্রিনিং। বৃহস্পতিবার। নিজস্ব চিত্র

কাগজে এত লেখালেখি হল! কিন্তু খবর পায়নি বুঝি ওরা।

Advertisement

তিন মাস পার করে প্রিয় ঠিকানায় ঢুকেও মনখারাপ মানিকতলার সুদেষ্ণা গোস্বামীর। “সাদার উপরে পাটকিলে ছোপ-ছোপ, সব থেকে কেঁদো চেহারার যেটি, দিব্যি শান্ত হয়ে আমার কোলে শুয়ে ঘুমোত। ওকে দেখতে না-পেয়ে একটুও ভাল লাগছে না!”— বৃহস্পতিবার দুপুরে মাস্ক নামিয়ে ইনফিউশনে চুমুকের ফাঁকে বলছিলেন তরুণী। পাশে বসে সহানুভূতিসূচক ঘাড় নাড়ছেন স্বামী ধীমান গণ। বছর দুয়েক আগে সুরেন্দ্রনাথ কলেজের ছাত্রী সুদেষ্ণার সঙ্গে ধীমানকে মিলিয়ে দিয়েছিল এই কফিহাউস।

তাঁদের চার হাত এক হলেও ফুরোয়নি কফিহাউসের আড্ডা। নিজেদের কফিহাউস পরিবারেরই অংশ বলে মনে করে এ দম্পতি। যুগলের বন্ধু অরুণিমা মুখোপাধ্যায় কফি-সিগারেটের মৌতাত মেখে ফোড়ন কাটেন, “অনেকে ভাবেন আজকাল যত নতুন প্রেম সব সোশ্যাল মিডিয়ার ইনবক্সেই ঘটে। ভাবনাটা ঠিক নয়, কফিহাউস আজও অজস্র প্রেমবন্ধুতার জন্ম দিয়ে চলেছে।” ধীমান-অরুণিমা-সায়ন-দ্বৈপায়ন-‘দিব্যেন্দুদাদের’ দলবল কেউ ছোটখাট ব্যবসা করেন, কেউ বা স্কুলশিক্ষক। কফিহাউসের প্রবল ভিড়ে টেবিল ভাগাভাগির ভবিতব্য, ক্রমে সিগারেটের ‘কাউন্টার’ তাঁদের এক সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছে। কফিহাউস ছাড়া এক দিনও পেটের ভাত হজম হত না। তাই তিন মাসের বিরহ পার করে তাঁদের আড্ডাতীর্থ খুলতে প্রথম দিনেই এক রকম হামলা পড়েছেন। ধীমান বললেন, “কফিহাউস খুলছে আর আমরা খবর পাব না! কিন্তু বেড়ালগুলোর কী হল বলতে পারেন! হুলোটাকে লাদেন বলে ডাকতাম।”

Advertisement

কফিহাউসের আড্ডাধারীদের জোট, কফি হাউস সোশ্যাল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক অচিন্ত্য লাহা অবশ্য বেড়ালপ্রেমী বলে নিজেকে মানবেন না। কিন্তু তিনিও বলছেন, “বেড়ালরাও অবশ্যই কফিহাউস পরিবারের অংশ। কফিহাউস শুধু দু’পেয়েদের, সেটা ভাবা ঠিক হবে না।” ঐতিহ্যশালী এই প্রতিষ্ঠানে এত দিন খান কুড়ি-পঁচিশ ছোট-বড় বেড়াল টেবিলের তলায় তলায় ঘুরঘুর করত। মায়ার বাঁধনে জড়ানো মার্জারকুলের প্রতি অবশ্য খুব রাগ কফিহাউসের তিন দশকের কর্মী জয়দেব বেরার। কফিহাউসের সঙ্গে সঙ্গে আঠারোর তরুণ থেকে মধ্য চল্লিশের জয়দেববাবু নিজেও বেড়ে উঠেছেন। টেবিলে কফি-ওমলেট পৌঁছতে পৌঁছতে বললেন, “বেড়ালগুলোর জন্য চিন্তা হচ্ছে। কী জানি, লকডাউনে তিন মাস না-খেতে পেয়ে কোথায় গেল হতচ্ছাড়ারা। থাকলে জ্বালায়, না-থেকেও জ্বালাচ্ছে।” তবে তাঁর ধারণা, মেনুতে চিকেন ফিরলে হয়তো ঠিকই ফিরে আসবে বেড়াল-বাহিনী।

কফিহাউসের এখনকার পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত ‘ইন্ডিয়ান কফি ওয়ার্কার্স কোঅপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড’-এর সম্পাদক তপন পাহাড়ি আশ্বাস দিচ্ছেন, “পুরনো মেনুও ফিরবে ঠিকই। কিন্তু প্রথমটা কী রকম সাড়া মিলবে, তা দেখে নেওয়া হচ্ছে।” কলেজ স্ট্রিটের পাশাপাশি অবশ্য খুলেছে যাদবপুর কফিহাউসও। দেওয়ালে টাঙানো ‘মাস্ক পরা আবশ্যক’ লেখা হুঁশিয়ারি। থার্মাল স্ক্রিনিং, পা দিয়ে বোতাম টিপে স্যানিটাইজ়ার মেখে নেওয়া সবই নব্য স্বাভাবিকতার অঙ্গ। কলেজ স্ট্রিটের ঠিকানায় উপরের তলাটি এখন বন্ধ। নীচের অংশে সর্বাধিক ২৫টি টেবিল। পঁয়ষট্টির বেশি বয়সিদের তা-ও ঢুকতে বারণ করা হচ্ছে। সল্টলেকের বাসিন্দা, বইপাড়ার ব্যবসায়ী অমিত গুপ্ত টেবিলে বসে বললেন, “১৯৬৭ থেকে আসছি। তখন আমি হিন্দু স্কুলে, ক্লাস নাইন। এখানে এলে আমার বয়স কখনওই মেরেকেটে চল্লিশের বেশি নয়।”

স্কুল-কলেজ বন্ধ। তাই এখনই পরিস্থিতি আগের মতো হওয়া সম্ভব নয়, জানেন কফিহাউস কর্তৃপক্ষ। তবু কলেজ স্ট্রিট-যাদবপুরে চেষ্টা চালাতেই হচ্ছে। মাঝে কর্মচারীদের অনেকেই বেতনও পাননি। তবু কলকাতার ছন্দে ফিরতে কফিহাউসের বিকল্প নেই, আজও— এটাই এখনও অনেকের অভিমত। মা-মাসির সঙ্গে স্কুলের বই কিনে এ দিনই প্রথম বার কফিহাউসে এসেছিল হাওড়ার মেয়ে, দশম শ্রেণির ছাত্রী পর্ণা মণ্ডল। বলছে, “খুব ইচ্ছে ডাক্তারি পড়ার। যদি মেডিক্যাল কলেজে সুযোগ পাই, তা হলে বন্ধুদের সঙ্গে নিশ্চয়ই আড্ডা দিতে আসব কফিহাউসে।” ঐতিহ্যের পুরনো দেওয়ালে অনাগত দিনের বাণী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন