দন্ত চিকিৎসার পথিকৃৎকে মনে রাখেনি কেউ

ধুলো-ময়লায় ঢাকা আগাছার জঙ্গলে সাদা এক খণ্ড পাথর উঁকি মারছে। তাতে ইংরেজিতে খোদাই করা—‘ডাক্তার রফিউদ্দিন আহমেদ (১৮৯০-১৯৬৫)

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০১৭ ০৩:২৩
Share:

অবহেলা: আর আহমেদ।

গোবরায় তিন নম্বর কবরস্থানের এ মাথা থেকে ও মাথা আঁতিপাঁতি করে খুঁজছেন কয়েক জন বর্ষীয়ান চিকিৎসক! এখানেই কোথাও রয়েছে বলে তাঁরা শুনেছেন। এত বড় এলাকা। এত কবর। এর মধ্যে সেটা খুঁজে বার করা বেশ দুরূহ কাজ। শেষে মুশকিল-আসানের ভূমিকায় কবরস্থানের বহু পুরনো কর্মী হাসানভাই। ‘‘ডগদরবাবুর কবর তো? অনেক বছর আগে কয়েক জন এসেছিলেন। তার পর থেকে কাউকে দেখিনি। চলুন, ওই দিকে আছে।’’

Advertisement

ধুলো-ময়লায় ঢাকা আগাছার জঙ্গলে সাদা এক খণ্ড পাথর উঁকি মারছে। তাতে ইংরেজিতে খোদাই করা—‘ডাক্তার রফিউদ্দিন আহমেদ (১৮৯০-১৯৬৫)। এখানেই মাটির তলায় শুয়ে রয়েছেন ভারতের দন্ত চিকিৎসার ইতিহাসের জনক।’’ কিন্তু কেউ মনে রাখেনি।

মৌলালি মোড়ে ব্যস্ত রাজপথের ধারে তাঁর নাম সঙ্গে নিয়েই দাঁড়িয়ে রাজ্যের এক নম্বর সরকারি দাঁতের হাসপাতাল তথা মেডিক্যাল কলেজ। কিন্তু অভিযোগ, শুধু সাধারণ মানুষই নন, দাঁতের চিকিৎসক বা ডেন্টাল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও ওই যুগান্তকারী দন্তচিকিৎসকের স্মৃতিবিজড়িত জিনিসগুলির সংরক্ষণ বা তাঁর সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করার তাগিদ সে ভাবে চোখে পড়েনি। পড়লে যে চিকিৎসকের জন্মদিনকে (২৪ ডিসেম্বর) গত বছর থেকে ‘ন্যাশনাল ডেন্টিস্ট ডে’ হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে, তাঁর সমাধি এতটা অনাদরে থাকতে পারে?

Advertisement

এত দিন পরে খানিকটা আচমকাই এই সমাধির অবস্থা সরেজমিন দেখার কথা মনে পড়েছিল ‘ইন্ডিয়ান ডেন্টাল অ্যাসোসিয়েশন’-এর কলকাতা শাখার চিকিৎসকদের। ১৯২০ সালে এই কলকাতা শহর থেকেই ভারতে আধুনিক দাঁতের চিকিৎসা শুরু করেছিলেন আর আহমেদ। তৈরি করেন ভারতের প্রথম ডেন্টাল কলেজ। ২০২০ সালে তার একশো বছর পূর্ণ হওয়ার কথা। ২০১৮ সাল থেকেই বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তার উদ্‌যাপন শুরুর পরিকল্পনা রয়েছে কলকাতা শাখার। সম্প্রতি তা নিয়ে আলোচনার সময়েই কেউ এক জন তুলে এনেছিলেন হতশ্রী সমাধির কথা।

গত সপ্তাহে দল বেঁধে সেখানে গিয়েছিলেন কলকাতা শাখার চিকিৎসকেরা। শাখার সচিব জয়দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘আমরা লজ্জিত। সব দায়িত্ব সরকার নেবে, এমনটা ভাবাও ঠিক নয়। কিছু দায়িত্ব আমাদেরও আছে, যেটা পালন করা হয়নি। তাই ঠিক হয়েছে, সমাধি সংস্কার করা হবে। ২৪ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক ভাবে সেই ঘোষণা করব।’’ সংগঠনের রাজ্য শাখার সদস্যেরাও সমাধির অবস্থা শুনে অস্বস্তিতে। রাজ্য সম্পাদক রাজু বিশ্বাসের কথায়, ‘‘আমাদেরও এত দিন যাওয়া হয়নি। কিন্তু ২৪ ডিসেম্বর ওঁর জন্মদিনে আমরা সমাধিক্ষেত্রে যাব। ডেন্টাল কলেজের পাশের রাস্তার নামও ওঁর নামে করার প্রস্তাব দিয়েছি আমরা।’’

কিন্তু কেন এত দিন তিনি ব্রাত্য? আর আহমেদের দৌহিত্রী জারিনা আলি এখন দাদুর কলেজে দাঁতের ডাক্তার। বললেন, ‘‘আর জি কর, নীলরতন সরকার বা বিধানচন্দ্র রায় সম্পর্কে লোকে তবু কিছুটা জানে। দাদু সম্পর্কে সেটুকুও জানে না।।’’ কবরের অবস্থা নিয়ে তাঁর মন্তব্য, ‘‘হতে পারে। আমি নিজেও দীর্ঘদিন সেখানে যাইনি।’’

দাঁতের প্রবীণ চিকিৎসক তথা ইন্ডিয়ান ডেন্টাল অ্যাসোসিয়েশনের কলকাতা শাখার সভাপতি অমিত রায় জানান, আর আহমেদ জন্মেছিলেন তৎকালীন পূর্ববঙ্গের বর্ধনপাড়ায়। আমেরিকায় দাঁতের চিকিৎসা নিয়ে পাশ করে কলকাতায় এসে ১৯২০-তে দাঁতের হাসপাতাল খোলেন। ১৯২৮ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা ‘হ্যান্ডবুক অব অপারেটিভ ডেন্টিস্ট্রি।’ পরে মৌলালিতে নিজের জমি ও বাড়ি সরকারকে দিয়ে দেন। সেখানেই দাঁতের হাসপাতাল স্থানান্তরিত হয়। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত তিনিই ছিলেন অধ্যক্ষ। ভারতে ডেন্টাল কাউন্সিলের প্রথম নির্বাচিত সভাপতি তিনি। স্বাধীন ভারতে পশ্চিমবঙ্গের কৃষি, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী ছিলেন। ছিলেন পুরসভার কাউন্সিলর।

ডেন্টাল কলেজে লোকচক্ষুর আড়ালে রয়েছে তাঁকে লেখা রবীন্দ্রনাথের একাধিক চিঠি। এমনই একটি চিঠিতে কবি নিজের পরিচিত এক জনের দাঁতের চিকিৎসা করার অনুরোধ জানিয়েছেন আর আহমেদকে। আবার চিঠির শেষে ছোট্ট নোটে লিখেছেন, ডক্টর আহমেদ তাঁর জন্য যে নকল দাঁত বানিয়ে দিয়েছেন, তা নিয়ে তিনি স্বচ্ছন্দেই রয়েছেন। এর জন্য ধন্যবাদও দিয়েছেন।

—নিজস্ব চিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন