পার্থর ফ্ল্যাটে ফরেন্সিক দল। বুধবার। — নিজস্ব চিত্র
একা ছিলেন মৃত্যুর আগে। মৃত্যুর পরেও কার্যত একাই রইলেন। দেহটুকু নিতেও এগিয়ে এলেন না কেউ।
মঙ্গলবার খিদিরপুরের অভিজাত আবাসনের ফ্ল্যাটে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত পার্থ দে-র দেহের ময়না-তদন্ত হয়েছে বুধবার। কিন্তু পুলিশ জানিয়েছে, পার্থর আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা সাফ জানিয়ে দেন, পার্থর দেহ নিয় তাঁদের কোনও মাথাব্যথা নেই। এই অবস্থায় ফাদার রডনি পুলিশকে জানিয়েছেন, পরিবার দেহ না-নিলে তিনিই অন্তিম সৎকারের ব্যবস্থা করবেন। মিশনারিজ অব চ্যারিটির তরফে এই ফাদার রডনিই গত দেড় বছর ধরে পার্থর দেখভাল করতেন।
পুলিশ জানিয়েছে, পার্থর আত্মীয়দের সঙ্গে ফের যোগাযোগ করার চেষ্টা হচ্ছে। তাঁদের উত্তরের জন্য পুলিশ দশ দিন অপেক্ষা করবে। তার মধ্যে কোনও ইতিবাচক সাড়া না-মিললে আদালতের কাছে বিষয়টি জানাবে। তখন আদালতের নির্দেশ মেনে অন্য কাউকে দেহ দেওয়া যেতে পারে। পার্থর দেহের ময়না-তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্ট বলছে, আত্মহত্যাই করেছেন তিনি। আগুনে পোড়া ছাড়া আর কোনও আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি তাঁর দেহে। পার্থর দু’টি ল্যাপটপ এবং দু’টি মোবাইল ফোন আটক করেছে পুলিশ। এই মৃত্যু নিয়ে কোনও মামলা রুজু হলে তখন সেগুলি ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হবে। এ দিন দুপুরে ফরেন্সিক নমুনা সংগ্রহকারীর একটি দল পার্থর ফ্ল্যাটে আসেন। তাঁরাও জানান, প্রাথমিক তদন্তে এখনও পর্যন্ত আত্মহত্যারই পাল্লা ভারী।
প্রাথমিক জেরায় পার্থর সারাক্ষণের পরিচারক প্রদীপ সরকারের বয়ানে কোনও অসঙ্গতি মেলেনি বলেই পুলিশ সূত্রের দাবি। তবে পার্থ রবিনসন স্ট্রিটের বাড়িটি কার কাছে বিক্রি করেছিলেন, তাঁর সম্পত্তির পরিমাণই বা বর্তমানে কত, তার দাবিদার কে হবে— এ সব নিয়ে খোঁজখবর শুরু হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ। ‘মিশনারিজ অব চ্যারিটি’ সূত্রের খবর, পার্থর সম্পত্তির কোনও অংশই দান করা হয়নি। পুলিশের অনুমান, সম্পত্তি বিক্রির টাকা পার্থর অ্যাকাউন্টেই রয়েছে। খিদিরপুরের অভিজাত আবাসনের যে ফ্ল্যাটটি পার্থ কিনেছিলেন, তার মালিককেও এ নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হবে।
আরও পড়ুন: সাইবার-সন্ত্রাস ঠেকাতে নয়া প্রযুক্তি পুলিশের
তবে সব কিছুর পরেও পার্থর এই অপমৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না অনেকেই। তাঁরা বলছেন, দীর্ঘদিন গভীর মানসিক অসুখের মধ্যে ডুবে থাকলেও গত দেড় বছরের চিকিৎসা তাঁকে অনেকটাই সুস্থ করে তুলেছিল। অবসাদ ও একাকিত্বের আঁধার থেকে ধীরে ধীরে যেন আলোয় ফিরছিলেন। ফাদার রডনি জানান, অনেক রকম সৃজনশীল কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন পার্থ। খুব সুন্দর রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন, গান শুনতেন। কবিতা শুনতেন, পড়তেন। নিজে লেখালেখিও করতেন।
পাভলভ থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে যাদবপুরের একটি সংস্থায় তাঁর কাউন্সেলিং চলত। সেখানে তিনি নিজে শিক্ষক হিসেবে কাজ করছিলেন বেশ কয়েক মাস আগে। শহরের রাস্তায় ঠান্ডা মাথায় খুব ভাল গাড়ি চালাতে পারতেন পার্থ। এগুলি সবই তাঁর সুস্থ হয়ে ওঠার এক-একটি ধাপ। এমনকী, মাস কয়েক আগে নিজের উদ্যোগে বিআইটিএম-এ বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রীদের নিয়ে মানসিক স্বাস্থ্যের উপরে একটি প্রতিযোগিতার আয়োজনও করেছিলেন।
মানসিক সমস্যা অনেকটা অতিক্রম করে ফেলার পরেও পার্থর গা থেকে ছাড়েনি ‘কঙ্কাল-পার্থ’, ‘হিচকক-পার্থ’, ‘সাইকো-পার্থ’— এই তকমাগুলি। আক্ষেপ করছিলেন ফাদার রডনি। বলছিলেন, ‘‘অসুস্থতার অন্ধকার থেকে উঠে এসে এই সমাজের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন পার্থ। কিন্তু এই সমাজ কখনওই সাহায্যের হাত বাড়ায়নি পার্থের দিকে।’’ এখনও পর্যন্ত কোথাও কঙ্কাল উদ্ধার হলেই টিভির পর্দায় সেই ঘটনার বর্ণনার পাশাপাশি দেখানো হতো পার্থর মুখ। ‘‘ও মেনে নিতে পারত না। বারবার বলত, ‘আমি ক্রিমিনাল নই, আমি অসুস্থ ছিলাম।’ ও দিনের পর দিন আরও একা হয়ে গিয়েছে এ সব ঘটনায়।’’— বললেন ফাদার রডনি।
চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, পার্থর যে ধরনের মানসিক সমস্যা রয়েছে, তাকে ডাক্তারি পরিভাষায় স্কিৎজোফ্রেনিয়া বলে। এই অসুখ কখন যে কোন পরিস্থিতি তৈরি করে, তা রোগীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সে রকমই কোনও মানসিক পরিস্থিতি হয়তো পার্থকে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দিয়েছিল। হয়তো সেই পরিস্থিতিটুকু পার করে দিতে পারলেই আবার মুহূর্তের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে যেতে পারতেন তিনি।
সমস্ত সম্ভাবনা অধরাই থেকে গেল।