বই নয়, তবু ওরা বইমেলায়

খানিক দূর থেকে পিংপং বল ছোট বালতিতে ফেলার প্রতিযোগিতায় সামিল এক ঝাঁক তরুণ তরুণী। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলায়। কম্পিউটারের ‘অ্যান্টি ভাইরাস’-এর এক সংস্থার স্টলে এই অভিনব নারী বনাম পুরুষ লড়াইয়ের সাক্ষী থাকা গেল।

Advertisement

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০২:৪৫
Share:

পেটপুজো: বই থেকে স্বাদ বদল। সেন্ট্রাল পার্কে। ছবি: শৌভিক দে।

ভরসন্ধ্যায় ত্রাহি-ত্রাহি রবে রিনরিন করছে নারীকণ্ঠ। সুবেশা তরুণী বলে চলেছেন, ‘গেল গেল, মেয়েরা কিছু করো, ছেলেরা যে জিতে গেল!’

Advertisement

খানিক দূর থেকে পিংপং বল ছোট বালতিতে ফেলার প্রতিযোগিতায় সামিল এক ঝাঁক তরুণ তরুণী। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলায়। কম্পিউটারের ‘অ্যান্টি ভাইরাস’-এর এক সংস্থার স্টলে এই অভিনব নারী বনাম পুরুষ লড়াইয়ের সাক্ষী থাকা গেল।

মেলার মূল ফটকে ঢুকে বুকসেলার্স অ্যান্ড পাবলিশার্স গিল্ড-এর অফিসের দিকে এগোলেই আবার দু’ধারে দুই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাভিলিয়ন। একটিতে জমিয়ে ক্যুইজের আসর বসেছে। অন্যটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কোর্সের হাল-হদিস মিলছে। বইও কিছু রয়েছে। তা সংস্থার কর্ণধারের লেখা। আর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আবার মেলার মাঠে নিজেদের মেলে ধরতে রুশ দেশে আসন্ন বিশ্বকাপ ফুটবলের নির্ঘণ্ট বিলি করছে।

Advertisement

বইমেলায় নতুন বাংলা বই ঘেঁটে দেখতে খুদে খুদে স্টলের সন্ধানে জুতোর সুখতলা ক্ষয়ে যেতে পারে! তবে বইয়ের সঙ্গে যৎসামান্য সম্পর্কের অনেক হেভিওয়েটই মেলা আলো করে রয়েছে। শিক্ষা জগতের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের সঙ্গে বইমেলার সম্পর্ক তবুও খুঁজে বার করা যায়। কিন্তু বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক, বিমা সংস্থা মেলায় কী করছে? প্রশ্ন করলে উদ্যোক্তা গিল্ড-এর বাঘা কর্তারাও জিভ কাটবেন! ‘‘স্পনসর ছাড়া এত বড় বইমেলা হয় নাকি?’’ ২০১২-র পর থেকে বইমেলায় আমজনতার প্রবেশ অবাধ হয়েছে। সঙ্গে বেড়েছে স্পনসর-নির্ভরতা। গিল্ডের কর্তা ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যা, ‘‘বেশি লোকে যাতে বইমেলায় আসতে পারে, তার ব্যবস্থা করতে পৃষ্ঠপোষকদের উপরে খানিকটা নির্ভর করতেই হয়।’’ সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের কিন্তু ধন্দ, ‘‘বইমেলায় ভিড় বাড়লেও পাঠক বাড়ছে কি না স্পষ্ট নয়!’’ তাঁর কথায়, ‘‘বইমেলা জমলে বা দু’-তিন জন লেখকের মোটা বই লোকে কিনলেও সার্বিক ভাবে তা বইচর্চার সুলক্ষণ বলা যায় না।’’ অনেকেরই প্রশ্ন, বইমেলার পৃষ্ঠপোষকতা বাড়লেও তা সাহিত্যচর্চার মান বাড়াতে কি আদৌ সাহায্য করছে?

মিলনমেলা থেকে সল্টলেকের ছোট জায়গায় স্পনসরদের উপস্থিতি কিছুটা কমেছে বলেই দাবি উদ্যোক্তাদের। সরাসরি বই প্রকাশে জড়িত নয়, এমন স্টল ২০-২৫টি হবে। বেসরকারি হাসপাতাল, খাদি, সরকারি চটসামগ্রীর সংস্থা, নেট বা মোবাইল পরিষেবা সংস্থা, আচার-হজমি— সক্কলে হাজির। এমনকী, রাজ্য পুলিশও পাঁচ নম্বর গেটের পাশে বিশাল জায়গা নিয়েছে। উদ্যোক্তারা সবিনয় কবুল করেন, পুলিশ এত সাহায্য করে, তার বিনিময়ে এটুকু নিখরচায় দিতেই হয়! কিন্তু বইমেলায় ভিড় হয় বলেই তো জনস্বার্থে পুলিশকে দায়িত্ব পালন করতে হয়? সেখানে এতটা জায়গা তারা কেন দখল করে বসবে? সদুত্তর নেই।

বইমেলার খরচ সামলাতে বা মেলা থেকে আয় করতে খাবারের স্টলের উপরেও নির্ভর করতে হয় বলে দাবি করেন উদ্যোক্তারা। গিল্ড-কর্তাদের দাবি, এ বার খাবারের দোকান কমাতে হয়েছে। ফলে, ৫০ শতাংশ আয় কমেছে। বইমেলার কর্তাদের মতে, ফ্রাঙ্কফুর্ট আর কলকাতার বইমেলা এক নয়। ফ্রাঙ্কফুর্টে বিভিন্ন প্রকাশক গোষ্ঠীর সম্মেলন। আর কলকাতা আমপাঠকের মেলা। মস্কো বা লন্ডনের বইমেলাকে ছাপিয়ে ভিড়ের নিরিখে কলকাতা যে দুনিয়ায় এগিয়ে, তা বারবার বলেন উদ্যোক্তারা। তাঁদের দাবি, বইমেলার সামান্য আয় বা উদ্বৃত্ত টাকা থেকে রাজ্য জুড়ে বছরভর বিভিন্ন মেলারও আয়োজন করে গিল্ড। তাই আয়ের রাস্তা খুঁজতেই হয়।

উদ্যোক্তাদের এই আয়ের তাগিদ থেকেই কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ‘দিদির বাংলা’র মেলায় মোদীর গুজরাতও জাঁকিয়ে বসেছে। গেটের কাছেই ‘গুজরাত ট্যুরিজম’-এর স্টলে বইয়ের নামগন্ধ নেই। কচ্ছের রান, অমদাবাদ ও সোমনাথ মন্দিরের ফিরিস্তির পুস্তিকা বিলি হচ্ছে। ম্যানেজার বাপ্পাদিত্য রায় হাসলেন, ‘‘গুজরাতের লোক ব্যবসা বোঝে। দুর্গাপুজোর মতো বইমেলাও বাংলার বাজার ধরার মঞ্চ। তাই ভেবেচিন্তেই এখানে স্টল কিনে গুজরাত নিজেদের মেলে ধরছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন