ভাতের পাতে ছোট্ট আনন্দ। শুক্রবার, নীলরতন সরকার হাসপাতালে। —নিজস্ব চিত্র।
সাত মাসের এক শিশুকে নিয়ে হাসপাতালের গুরুগম্ভীর আবহে ঝলমলে উৎসব।
ওষুধগুলো আজ যেন অত তেতো লাগছে না। সূচ ফোটানোর যন্ত্রণাও যেন খানিকটা কম। শরীরের কষ্ট কিছু ক্ষণের জন্য ভুলে যেতে পেরেছে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু শল্য বিভাগে ভর্তি ছোট্ট ছোট্ট রোগীরা। আজ যে আনন্দের অন্নপ্রাশন!
কোন আনন্দ?
যাকে হাওড়ায় কোনও এক রেললাইনের ধার থেকে কুড়িয়ে পেয়ে হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলেন এক পথচারী। দিনটা ২০১৪ সালের ৬ সেপ্টেম্বর। নামগোত্রহীন সদ্যোজাত তখন মৃতপ্রায়। জন্ম থেকেই তার সুষুন্মাকাণ্ডের স্নায়ুগুলো বিপজ্জনক ভাবে বাইরে বেরিয়ে ছিল। রাস্তার ময়লায় পড়ে থেকে সংক্রমণ শুরু হয়ে গিয়েছিল তাতে। সেই সঙ্গে মলনালী ও মলদ্বার ছিল না শরীরে। আর কোমরের নীচ থেকে বাকি অংশ ছিল অসাড়। হয়তো শারীরিক এই সমস্যাগুলোর জন্যই জন্মের পরে নিতান্ত অবহেলায় তাকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে গিয়েছিল তার আপনজনেরা। হাসপাতালের অনাত্মীয়েরাই তাকে সাদর গ্রহণ করেন। নতুন নাম দেন, ‘আনন্দ।’
চিকিৎসকেরা নিজেরা উদ্যোগী হয়ে একাধিক অস্ত্রোপচারে তার শরীরে মল বার হওয়ার রাস্তা তৈরি করেন। সুষুন্মাকাণ্ডের স্নায়ুগুলো ভিতরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু শরীরের অসা়ড় অংশে সাড় ফেরে না। তাতে কী? গোটা শিশু শল্য বিভাগ আনন্দকে বড় করার ভার নিজেদের হাতে তুলে নেয়। হাসপাতালে ভর্তি অন্য শিশুর মায়েরা পালা করে আনন্দকে নিজেদের দুধ খাওয়াতে শুরু করেন। অপরিচিতেরাই তার আপনার হয়ে ওঠেন, বুকে করে বড় করেন। সাত মাসে পা দেওয়ার পরে তাঁরাই উদ্যোগী হন মুখেভাত দেওয়ার জন্য। হইহই করে আয়োজন হয়ে যায়। হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স, চিকিৎসাকর্মী, রোগীর আত্মীয়েরা— সবাই যোগ দেন। তাঁরাই চাঁদা তোলেন। শুক্রবার শিশু শল্য বিভাগে আনন্দের অন্নপ্রাশনে কব্জি ডুবিয়ে খেলেন ৮৫ জন। রান্না হল হাসপাতালের কিচেনে। ভাত, ডাল, ভাজা, মাছ, মাংস, পায়েস, মিষ্টি। আর আনন্দ ওরফে তাঁদের আদরের ছোটকুর জন্য আলাদা করে বাড়ি থেকে রেঁধে নিয়ে এলেন গোপা সিস্টার, পুতুল সিস্টার, মণীষা সিস্টার, উমাদি, অনিতাদি-রা।
এ দিন দুপুরে নীলরতনের শিশু শল্য বিভাগে ঢুকেই মনে হল এ নিশ্চয়ই হাসপাতাল নয়। চার দিকে যন্ত্রণাক্লিষ্ট, চিন্তাভরা মুখগুলোয় আলো ঝিকমিক করছে। বেলুনে-কাগজের মালায় চার দিক সাজানো, বাচ্চাদের ছুটোছুটি-হইহল্লা। খওয়াদাওয়ার দেদার আয়োজন। শাঁখে ফু আর উলুর আওয়াজের মাঝখানে আনন্দের মুখে ভাত তুলে দিলেন বিভাগের চতুর্থ শ্রেণির কর্মী শুভেন্দু সাঁতরা। নিজেকে যিনি ‘আনন্দের মামা’ বলে পরিচয় দিতে বেশি ভালবাসেন। গরদের ধুতি-পাঞ্জাবি, টোপর, মালায় সাজানো রাজপুত্র এ কোল থেকে ও কোলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কখনও ঠোঁট ফোলাচ্ছে, কখনও খিলখিলিয়ে হাসছে।
সে দিকে তাকিয়ে চিকিৎসক কৌশিক সাহা জানালেন, আরও দু’টি শিশুকে রাস্তা থেকে তুলে তাঁদের বিভাগে ভর্তি করা হয়েছিল। দু’টিই মেয়ে। তার মধ্যে একটি শিশুর দেহ কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছিল রাস্তার কুকুর। প্রায় সাড়ে তিন বছর হাসপাতালে থাকার পরে তাকে এক দম্পতি দত্তক নেন। অন্য মেয়েটিকেও আট মাসে অন্য এক দম্পতি দত্তক নিয়েছেন। তবে আনন্দের জন্য তাঁরা একটু চিন্তিত। কারণ, সে কোনওদিনও হাঁটাচলা করতে পারবে না। এমন শিশুকে কেউ দত্তক নিতেও হয়তো আগ্রহী হবেন না।
চিকিৎসকেরা অবশ্য মনে করছেন, ভাল ভাবে চিকিৎসা, একাধিক অস্ত্রোপচার, টানা ফিজিওথেরাপি করালে পায়ে ক্যালিপার পরে সে ভবিষ্যতে খানিকটা চলাফেরা করতেও পারে। কিন্তু কে এগিয়ে আসবে, সেটুকু সাহায্য নিয়ে? না আসুক, হাল ছাড়ছেন না আনন্দের সত্যিকারের আত্মীয়েরা। আনন্দকে কি এত সহজে ফুরিয়ে যেতে দিতে আছে?