—প্রতীকী ছবি।
রাত বারোটা। পার্কিং লট থেকে বেরোনোর সময়েই এক ঝটকায় বেড়ে গেল গাড়ির গতি। আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা সকলে ছিটকে গেলেন। বেরোলো গাড়িটা।
জায়গাটি পার্ক স্ট্রিটের লোরেটো হাউসের কাছে অভিজাত এক নাইট ক্লাব। পার্টি শেষে হই হই করে বেরিয়ে এলেন একদল তরুণ-তরুণী। সাজপোশাক বলছে, সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণির বেশ উপরের দিকেই এঁদের আর্থিক অবস্থান। পদক্ষেপ বলছে, সকলেরই নেশার পারদ চড়ে রয়েছে কম-বেশি। ছিটকে এল এক তরুণের গলা। ‘‘শুক্রবার রাত আজ। এত তাড়াতাড়ি কেউ বাড়ি ফেরে নাকি? বললাম আরও খাই...।’’ দুই তরুণীর উত্তর, আরও দেরি হলে বাড়ি ফেরা মুশকিল হবে। তরুণের আশ্বাস, ‘‘আমি পৌঁছে দিতাম।’’ বলতে বলতেই সামনে পার্ক করা গাড়ির চালকের আসনে উঠে বসলেন তরুণ। বেসামাল পদক্ষেপ তখনও স্পষ্ট। উঠলেন দুই বন্ধুও। সেই গাড়ির লাগামহীন গতিতেই হঠাৎ ছিটকে গেলেন সকলে।
আরও পড়ুন: সোনিকার সঙ্গে ঝগড়া হয়েছিল কি
রাত দেড়টা। পার্ক স্ট্রিটের নামী ডিস্কের পার্কিং লট। এ যেন শহরের ভিতরে আর এক টুকরো শহর। আলো, মদ, নাচ, গান, ধোঁয়ায় মোড়া এই এলাকা রাতভর ঘুমোয় না। বরং রাত যত বাড়ে, ততই জমে আসর। তখন যেন সবে সন্ধ্যা। সাঁ সাঁ করে ঢুকছে একের পর এক দামি গাড়ি। ভিতরে তখন পা ফেলার জায়গা নেই। গানে-নাচে প্রবল দাপটের সঙ্গে পেরোচ্ছে ‘ফ্রাইডে নাইট’।
এই পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। গোল বাঁধল রাত বাড়তে। কয়েক ঘণ্টা সময় কাটানোর পরে, ডান্স ফ্লোরের ভিড় যখন প্রায় পুরোটাই বার কাউন্টারে ঝুঁকে পড়েছে, তখনই ফেরার সময় হয়ে যায়। কেউ টলতে টলতে, কেউ বা অন্যের কাঁধে ভর দিয়ে বেরোচ্ছেন। অনেকেই ক্যাব ডাকছেন, অনেকেই চালককে নির্দেশ দিচ্ছেন গাড়ি আনার। কিন্তু এই দু’প্রকার বাদেও রয়েছেন তৃতীয় এক প্রকারের মানুষ। তাঁরা নিজেরাই পার্কিংয়ের দিকে এগোচ্ছেন গাড়ির খোঁজে। এবং যথারীতি, এঁদের মধ্যে অনেকেরই পদক্ষেপ বলে দিচ্ছে, ‘স্বাভাবিক’ নেই তাঁরা।
বড় রাস্তায় এসে দাঁড়ালে এই গাড়িগুলিকেই ফের দেখা যায়। তীব্র গতিতে বেরিয়ে যাচ্ছে। এ দিকে নিজের চোখে সদ্য দেখা অভিজ্ঞতা বলছে, স্টিয়ারিংয়ে রয়েছে নেশাতুর হাত।
উদ্দাম গতির গাড়ি, স্টিয়ারিংয়ে মত্ত চালক, গতি সামাল দিতে না পেরে দুর্ঘটনা, তার জেরে চোট, আঘাত মৃত্যু— রাতের শহরে এ সব ঘটনা ক্রমেই অতি পরিচিত হয়ে উঠছে। অভিনেতা বিক্রম চট্টোপাধ্যায়ের সাম্প্রতিকতম গ্রেফতারি আরও এক বার মনে করিয়ে দিয়েছে, এ রকমই উদ্দামতার মাসুল গুনতে গিয়ে চলে গিয়েছে তরুণী মডেল সোনিকা সিংহ চৌহানের প্রাণ। কিন্তু এই ঘটনা কি কোনও বার্তা দিতে পারল?
শুক্রবার রাতের কলকাতা বলছে, না। মত্ত অবস্থায় স্টিয়ারিংয়ে বসার অভ্যাসে এতটুকু টোল ফেলতে পারেনি বিক্রম-কাণ্ড।
প্রশ্ন জাগে, এ ভাবেই কি চলতে থাকবে বেপরোয়া এবং বেসামাল গাড়ির দাপট?
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিক্রম-কাণ্ডের পরেই পুলিশ বারের মালিকদের নির্দেশ দিয়েছিল, মদ্যপান করে যাঁরা বার থেকে বেরোবেন, তাঁরা কী অবস্থায় আছেন, বার কর্তৃপক্ষই তা যাচাই করে দেখুন এবং প্রয়োজনমতো ব্যবস্থা নিন।
তবে ‘হোটেল অ্যান্ড রেস্তোরাঁ অ্যাসোসিয়েশন অব ইস্টার্ন ইন্ডিয়া’-র প্রেসিডেন্ট সুদেশ পোদ্দার বলেন, ‘‘আমরা সচেতনতা বাড়ানোর কর্মসূচি নিতে পারি। তা করছিও। কিন্তু ক্রেতাদের ধরে পরীক্ষা করতে পারি না আমরা।’’ সঙ্গে তিনি জানান, মত্ত অবস্থায় গাড়ি চালানো রুখতে নানা পাব-এর সামনে খোলা হয়েছে অ্যাপ-ক্যাবের কিয়স্কও।
আর কী বলছে পুলিশ? ডিসি ট্র্যাফিক ভি সলোমন নেসা কুমার জানান, রাতে পথে আগের চেয়ে বেশি পুলিশকর্মী থাকছেন। তিনি বলেন, ‘‘মত্ত অবস্থায় গাড়ি চালাতে দেখলেই তিন মাসের জন্য লাইসেন্স আটক করা হচ্ছে।’’ পাশাপাশি তাঁর দাবি, নজরদাড়ি চলছে পানশালাগুলিতেও। যদিও সেই নজরদারি চোখে পড়েনি শুক্রবার রাতভর।