এক দিকে ভোটপর্ব, অন্য দিকে তীব্র গরম। এই দুইয়ের জেরে রক্ত সংগ্রহ ধাক্কা খাচ্ছে গোটা রাজ্য জুড়েই। ও পজিটিভ, বি পজিটিভের মতো গ্রুপের রক্তও মিলছে না অধিকাংশ ব্লাড ব্যাঙ্কে। এই পরিস্থিতিতে কলকাতার নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের ব্লাড ব্যাঙ্কে কর্মীদের একাংশের গাফিলতিতে বেশ কিছু ইউনিট ‘প্যাক্ড সেল’ নষ্ট হওয়ার অভিযোগ উঠল। দাতাদের থেকে রক্ত সংগ্রহের পরে ওই প্যাকড সেলগুলি সংরক্ষণ করতে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীরা ‘ভুলে’ গিয়েছিলেন বলে অভিযোগ।
পরদিন বিকেলে অন্য একটি ক্যাম্পে সংগৃহীত রক্ত সংরক্ষণের সময়ে বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে আসে। তখনই এ নিয়ে শোরগোল শুরু হয়ে যায়। তড়িঘড়ি রক্তের ওই প্যাক্ড সেল ফ্রিজে তুলে রাখার ব্যবস্থা হয়। কিন্তু প্যাক্ড সেল ছয় ডিগ্রি তাপমাত্রায় সংগৃহীত রাখার কথা। না হলে তা জমাট বেঁধে যায়। এ ক্ষেত্রে রেফ্রিজারেটরের বাইরে ছয় ডিগ্রির অনেক কম তাপমাত্রায় ওই প্যাক্ড সেলগুলি প্রায় ২৪ ঘণ্টা পড়ে ছিল। তাই নজরে আসার পরে ব্লাড ব্যাঙ্কের কর্মীরা তড়িঘড়ি তা তুলে রাখার ব্যবস্থা করলেও তা এখনও কোনও রোগীকে দেওয়া হয়নি। হাসপাতাল সূত্রে খবর, ব্লাড ব্যাঙ্কের চিকিৎসকদের একটা বড় অংশই মনে করছেন, ওই রক্ত কোনও রোগীকে দেওয়া চিকিৎসাশাস্ত্রে ন্যায়সঙ্গত হবে না। তাই আপাতত ওই রক্তের একটা বড় অংশ লেবেলবিহীন অবস্থায় হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্কেই পড়ে রয়েছে। কিছু ইউনিট সোমবার কয়েক জন রোগীকে দেওয়াও হয়েছে। এর ফলে রক্ত-সুরক্ষা বড় রকমের ধাক্কা খেয়েছে বলে আশঙ্কা চিকিৎসকদের একাংশের।
ব্লাড ব্যাঙ্কের অধিকর্তা দিলীপ পাণ্ডা অবশ্য দাবি করেছেন, তাঁকে কেউ বিষয়টি জানায়নি। কিন্তু স্বাস্থ্য ভবন সূত্রে খবর, তিনি সবই জানেন এবং এই ধরনের বিপর্য়ের জন্য তিনি ব্লাড ব্যাঙ্কে কর্মীর অভাবকেই দায়ী করেছেন? দিলীপবাবু বলেন, ‘‘আমি এ ব্যাপারে আর কোনও কথা বলতে চাই না।’’
স্বাস্থ্যকর্তারা অবশ্য জানিয়েছেন, তাঁরা বিষয়টিকে মোটেই লঘু করে দেখছেন না। দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘সমস্ত বিষয়টা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যাঁদের গাফিলতিতে এমন হয়েছে, তাঁদের বিরদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
স্বাস্থ্য ভবন সূত্রে খবর, ঘটনাটি ঘটেছে ৩০ এপ্রিল। সম্প্রতি তা স্বাস্থ্য ভবনের নজরে এসেছে। রক্তের সঙ্কট চলছিল বলে হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্কে ওই সময়ে ‘এক্সচেঞ্জ ডোনেশন’ চলছিল। অর্থাৎ, রোগীর পরিজনেরা যে কোনও গ্রুপের রক্ত দান করছেন ও বিনিময়ে তাঁদের চাহিদার রক্ত (যদি মজুত থাকে) নিয়ে যাচ্ছেন। হোল ব্লাডের পাশাপাশি ট্রিপল ব্যাক কালেকশনও চলছিল তখন। যার অর্থ রক্ত থেকে প্লেটলেট, ফ্রেশ ফ্রোজেন প্লাজমা ও প্যাকড সেলের মতো তিনটি উপাদান পৃথক করে সংরক্ষণ করা, যাতে এক ইউনিট রক্ত তিনটি পৃথক প্রয়োজনে তিন পৃথক ব্যক্তির কাজে লাগতে পারে।
অভিযোগ, প্লেটলেট এবং ফ্রেশ ফ্রোজেন প্লাজমা ঠিকমতো সংরক্ষণ হলেও প্যাকড সেলগুলি পড়ে ছিল ‘কম্পোনেন্ট সেপারেশন রুম’-এই। সেগুলি না তুলে রেখেই কর্মীরা চলে গিয়েছিলেন। ১ মে অর্থাৎ রবিবার, মে দিবসের বিকেলে রক্তদান শিবির থেকে রক্ত আসার পরে হুঁশ ফেরে সকলের।
হাসপাতাল সূত্রে খবর, এমন ঘটনা এই প্রথম নয়। প্লেটলেটের আয়ু পাঁচ দিন। অনেক সময়ে মেয়াদ পেরিয়ে যায়। সংগ্রহ করা প্লেটলেট ঠিকমতো ব্লাড ব্যাঙ্কের খাতায় নথিভুক্ত করা হয় না। তাই বহু সময়েই তা সঠিক সময়ে রোগীর পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া যায় না। গত রবিবারেই যেমন ৩০ ইউনিট প্লেটলেট ব্লাড ব্যাঙ্কে পড়েছিল। সোমবারের মধ্যে যেগুলির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। এক কর্মী বলেন, ‘‘যাঁরা চাইছেন সকলকে প্লেটলেট দেওয়া হয়েছে। কিন্তু রাস্তা থেকে লোক ডেকে তো আর বিলি করা য়ায় না। তাই তেমন পরিস্থিতি এলে উদ্বৃত্ত প্লেটলেট ফেলে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই।’’
ব্লাড ব্যাঙ্কের কর্মীরা অবশ্য জানিয়েছেন, প্লেটলেট সংরক্ষণের জন্য অ্যাজিটেটর নামে একটি যন্ত্র প্রয়োজন। হাসপাতালে এই মুহূর্তে যেটি আছে, অতি ব্যবহারে সেটি বিগড়োচ্ছে মাঝেমধ্যেই। যে অ্যাজিটেটরে ৪৮টি প্লেটলেট থাকার কথা, সেখানে কখনও কখনও ১০০ থেকে ১২০টা পর্যন্ত রাখা হয়। দিনের পর দিন এমন চলতে থাকলে যন্ত্র বিকল হবেই। অ্যাজিটেটরের সমস্যায় প্লেটলেট সংরক্ষণ নিয়ে বিপাকে পড়তে হচ্ছে মাঝেমধ্যেই। গত ডিসেম্বর থেকে নতুন অ্যাজিটেটর কেনার কথাবার্তা চললেও ছ’মাসে তা হয়ে ওঠেনি।