Online Studies

অনলাইনেই হাতেখড়ি, বদল শিক্ষার সংজ্ঞায়

শিক্ষকদের হাতে ধরে লেখা শেখানো বা অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে মেলামেশার মতো মানবিক স্পর্শগুলি থেকে শুরুতেই বঞ্চিত ওরা।

Advertisement

রূপকিনী সেনগুপ্ত

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ জুলাই ২০২১ ০৬:৩৪
Share:

প্রতীকী ছবি।

অতিমারি বিশ্বে গোটা একটা প্রজন্মের শিক্ষার শুরুটাই বদলে দিয়েছে। যে খুদেরা সবে লিখতে-পড়তে শুরু করেছে, তাদের অধিকাংশেরই হাতেখড়ি হয়েছে অনলাইনে। ফলে সামাজিক মেলামেশা, অন্য পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার মতো সাধারণ জীবনশৈলী থেকে পিছিয়ে পড়ছে তারা। বাড়ছে বাবা-মায়ের উপরে নির্ভরতা। বিদেশের এক পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, এই প্রজন্ম বড় হয়ে নিজেদের ‘লস্ট জেনারেশন’ ভাববে!

Advertisement

প্লে-স্কুল স্তর থেকেই শিক্ষার সঙ্গে এই অনলাইন পরিচয় নিয়ে উদ্বিগ্ন শিক্ষক থেকে অভিভাবকেরা। শিক্ষকদের হাতে ধরে লেখা শেখানো বা অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে মেলামেশার মতো মানবিক স্পর্শগুলি থেকে শুরুতেই বঞ্চিত ওরা। মনস্তত্ত্ব বলে, শিশুর মানসিক বিকাশে সামাজিক দক্ষতার গুরুত্ব অনেকটা। আর যার প্রাথমিক ধাপ ওরা স্কুলেই শেখে। অনলাইন ক্লাসের আলাপচারিতা কখনওই তার বিকল্প নয়।

গত এক বছরে দেশ তথা বিশ্বের অভিভাবকদের কথায় বার বার এই উদ্বেগ উঠে এসেছে। বাচ্চারা প্রয়োজনের বাইরে কারও সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না, বাড়ির বাইরের পরিবেশ সম্পর্কে ভয় তৈরি হচ্ছে শিশু মনে। মোবাইল বা ল্যাপটপেই অভ্যস্ত হচ্ছে ওরা। এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মনোরোগ চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, সমমনস্ক অন্য শিশুদের সঙ্গে বাচ্চারা ছোট থেকেই বন্ধুত্ব পাতায়। একে এই সব থেকে বঞ্চিত, তার উপরে অনলাইন ক্লাসের চাপ। ফলে বাড়ির লোক ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে ওরা মানসিক যোগাযোগ স্থাপন করতেই শিখছে না। অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে মেলামেশা, অন্য পরিবেশে কিছু ক্ষণ থাকতে পারা, নিয়মানুবর্তিতা, অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নিতে শেখা, জীবনের এই অতি প্রয়োজনীয় শিক্ষাগুলি থেকে ওরা বঞ্চিত হচ্ছে।

Advertisement

তবে বাচ্চাদের অনলাইন ক্লাস করানো নিয়ে ভিন্ন মতও পোষণ করেন অনেকে। বছর চারেকের এক খুদের মা নেহা তরফদার যেমন বলছেন, ‘‘আমার মেয়ে গত বছর থেকেই অনলাইন ক্লাস করছে। ওরা তাতেই সাবলীল।’’ এতে যে বাবা-মায়ের দায়িত্ব অনেকটা বেড়ে যাচ্ছে, তা-ও মানছেন তিনি। আর এক খুদের মা সানন্দা কর আবার বলছেন, “ছেলে আগে প্লে স্কুলে যেত। গত বছর অনলাইন ক্লাস করাইনি। তিন-চার বছরের বাচ্চাদের বাড়িতেই লেখাপড়া শেখানো যায়।’’

ওই বয়সের শিশুদের মস্তিষ্ক যে পড়াশোনা করার মতো উন্নত নয়, সে কথা জানাচ্ছেন ‘ইনস্টিটিউট অব সাইকায়াট্রি’র ডিরেক্টর প্রদীপ সাহাও। তাঁর কথায়, “পাঁচ বছর বয়সের আগে অনলাইনে শিক্ষা দেওয়া উচিত না। স্কুলে গেলে অন্য শিশুদের সঙ্গে মেলামেশা করে মানিয়ে নিতে শেখে। এর ফলে মানসিক বিকাশের যে সুযোগ থাকে, তা বাড়িতে আবদ্ধ থেকে সম্ভব না। ফলে নানা মানসিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে।” তিনি জানাচ্ছেন, বহু অভিভাবক তাঁদের জানাচ্ছেন, বাচ্চারা অল্পেই রেগে যাচ্ছে। কথা শুনছে না, খেতে চাইছে না, জেদি হয়ে যাচ্ছে। কোনও শিশু অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ হচ্ছে, কেউ আবার মানসিক ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে।

মনোরোগ চিকিৎসক রিমা মুখোপাধ্যায় বলছেন, “এই প্রজন্মের শিশুদের শিক্ষা এবং স্কুলের ধারণাটাই সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যাচ্ছে। পড়াশোনা হয়তো শেখানো যাবে, কিন্তু জীবনে প্রথম স্কুলে গিয়ে বাচ্চারা আরও অনেক কিছু শেখে। সেটা না হওয়ায় ওদের সামাজিক দক্ষতা তৈরি হচ্ছে না। বাবা-মায়েরা সব করে দিচ্ছেন, ফলে শিশুরা আত্মনির্ভর হচ্ছে না। একটু বড় হয়ে স্কুলে গেলে হয়তো এগুলো শিখে যাবে। কিন্তু কিছুটা সমস্যা হতেই পারে।”

সমস্যার কথা মেনে নিয়েও আশার আলো দেখাচ্ছেন শিক্ষকেরা। যেমন, মহাদেবী বিড়লা ওয়ার্ল্ড অ্যাকাডেমির প্রধান শিক্ষিকা অঞ্জনা সাহা বললেন, “অনলাইন ক্লাসে শিক্ষকদের সঙ্গে বাচ্চাদের গল্প বলার আসর করা যেতে পারে। অন্য বাচ্চাদের দেখলে, গলা শুনলেও বাচ্চারা খুশি হয়।” এ ভাবেই আগামী প্রজন্মকে স্বাভাবিক জীবন দিতে চেষ্টা করছেন তাঁরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন