পাভলভের দরজায় এক ঝলক পার্থ। মঙ্গলবার শৌভিক দে-র তোলা ছবি।
ওঁরা বিশ্বাস করতেন, হৃৎস্পন্দন বন্ধ হলেও আত্মা থেকে যায়। বাবা, মেয়ে, ছেলে— তিন জনের কারওরই মৃত্যুর পরে সৎকার বা শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিকতায় ছিটেফোঁটা ভক্তি ছিল না। পার্থ দে-র দিদি দেবযানী ও বাড়ির পোষা দু’টি ল্যাব্রাডরের মৃত্যুর পরে সে-জন্যই তিনটি দেহ বাড়িতে রাখা ছিল বলে পুলিশের অনুমান।
এখনও পর্যন্ত তদন্তে যা উঠে এসেছে, তার ভিত্তিতে পুলিশের ধারণা, মৃত্যুর পরে প্রিয়জনের দেহ রেখে দেওয়ার অদ্ভূত আচরণ এবং বিচিত্র ধার্মিক ক্রিয়াকলাপে মশগুল থাকার বাড়াবাড়িটুকু বাদ দিলে রবিনসন স্ট্রিট দে-বাড়ির কাণ্ডে কোনও বড়সড় অপরাধের যোগ নেই। যদিও এ বিষয়ে এখনই শেষ কথা বলার পক্ষপাতী নন লালবাজারের কর্তারা। তবে একটা বিষয়ে তাঁরা নিশ্চিত, অদ্ভূত আচরণের বীজটা পার্থ ও দেবযানীর মধ্যে ঢুকে পড়ার নেপথ্যে তাঁদের বাবা অরবিন্দবাবুরও যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। পরিবারের অন্য আত্মীয়দের মৃত্যুর পরে অন্ত্যেষ্টি বা শ্রাদ্ধ-শান্তি নিয়ে অরবিন্দবাবু যে আপত্তি করেছিলেন, পুলিশ তা জানতে পেরেছে।
২০০৫ সালে স্ত্রী আরতিদেবী মারা যাওয়ার পরে তাঁর দেহ নিয়ে শ্মশানে যাননি অরবিন্দবাবু। পার্থ তখন বিদেশে ছিলেন। মায়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে তিনি দেশে ফেরেননি। সে যাত্রা পার্থর কাকা অরুণবাবু বৌদির দেহ কেওড়াতলা শ্মশানে নিয়ে গিয়ে সৎকার করেন। আরতিদেবীর শ্রাদ্ধানুষ্ঠানেও অরবিন্দবাবু অত্যন্ত নিমরাজি হয়ে উপস্থিত ছিলেন। তদন্তকারীদের একাংশের ধারণা, আরতিদেবীর মৃত্যুর বিষয়টি জানাজানি না-হলে স্বামী-পুত্রকন্যা তাঁর দেহ নিয়ে কী করতেন, বলা শক্ত। এর বহু বছর আগে অরবিন্দবাবুর বাবা গদাধর দে যখন মারা যান, তখন বাবার মৃত্যুর খবর শুনেও বেঙ্গালুরু থেকে কলকাতায় ফেরেননি অরবিন্দবাবু। এই নিয়ে অরবিন্দবাবুর মা শান্তিদেবী ও ভাই অরুণবাবুর পরিবারের সঙ্গে অরবিন্দবাবুদের তিক্ততার সৃষ্টি হয়। গত বছর শান্তিদেবীর মৃত্যুর পরেও অরবিন্দবাবুর পরিবারের তরফে কেউই তাঁকে দেখতে যাননি।
সব মিলিয়ে রবিনসন স্ট্রিটে পার্থদের ফ্ল্যাট থেকে পাওয়া বিভিন্ন নথি, ডায়েরি, চিরকুট এবং পার্থর বিভিন্ন বয়ানের সূত্র ধরে তদন্তকারীরা মনে করছেন, মৃত্যুকে মানতে না-চাওয়াটাই অরবিন্দবাবুর ছেলেমেয়েদের প্রধান সমস্যা হয়ে দেখা দেয়। তবে মৃতদেহ বাড়িতে জমিয়ে রাখার বিষয়টি অরবিন্দবাবুও মানতে পারেননি বলে পুলিশের ধারণা। মেয়ে ও ছেলের চাপে তিনি সম্ভবত এ সব সহ্য করতে বাধ্য হন। পুলিশের ধারণা, দু’টি কুকুর ও দেবযানীর দেহ বাড়িতে রাখার বিষয়টি অরবিন্দবাবু প্রথমটা জানতে পারেনি। অরবিন্দবাবু, দেবযানী ও পার্থর তিনটি ডায়েরি খুঁটিয়ে দেখে পুলিশ অরবিন্দবাবুর সঙ্গে দেবযানী ও পার্থের মনোমালিন্যের আভাস পেয়েছে। সেখান থেকেই মৃত কুকুরের দেহ বাড়িতে রাখার ব্যাপারে অরবিন্দবাবুর সায় ছিল না বলে পুলিশের ধারণা হয়েছে। আর পার্থ ইতিমধ্যেই পাভলভ হাসপাতালে মেডিক্যাল বোর্ডের কাছে দিদির দেহ বাড়িতে রাখার প্রসঙ্গে মুখ খুলেছেন। তাঁর দাবি, দিদির দেহ ঘরে রাখা, তাকে খেতে দেওয়ার কথা জানতে পেরে বাবা ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। আগুনে পুড়ে অরবিন্দবাবুর অপমৃত্যু না হলে পার্থর অদ্ভূত কাণ্ডকারখানা আরও কিছু দিন জারি থাকত বলেই পুলিশের ধারণা।
মাঝ রাতে রবিনসন স্ট্রিটে পার্থ দে-র বাড়ি। ছবি: প্রদীপ আদক।
তবে অরবিন্দবাবুর আত্মহত্যার কারণটি ঠিক কী, তা নিয়ে তদন্তকারীরা এখনও ধোঁয়াশায় রয়েছেন। ছেলেমেয়ের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি বা ভাই অরুণবাবুর পরিবারের সঙ্গে বিরোধের নানা তত্ত্ব এ পর্যন্ত উঠে এসেছে। যদিও অরুণবাবু আগে জানিয়েছিলেন, সম্প্রতি দু’ভাইয়ের সম্পর্ক ভাল হয়েছিল। পার্থর বয়ানেও জানা গিয়েছে, কফিশপে সম্প্রতি বাবা ও কাকার দেখা হয়েছিল। তবে পরিবারের বিভিন্ন সূত্রের সঙ্গে কথা বলে দু’ভাইয়ের (অরবিন্দ ও অরুণ) মধ্যে তিক্ততা ও অবিশ্বাসের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে বলে জানতে পেরেছে পুলিশ। এমনকী পুলিশের দাবি, ভাইয়ের হাতে আক্রান্ত হতে পারেন এই ভয়েই অরবিন্দবাবু বাড়িতে মোটা টাকায় ২৪ ঘণ্টার নিরাপত্তা রক্ষী মোতায়েন করেছিলেন।
১৯৮৯ সালে অরবিন্দবাবু বেঙ্গালুরু থেকে সপরিবার কলকাতায় ফিরে আসার পরে প্রথমে কিছু দিন রবিনসন স্ট্রিটের বাড়িতে ফিরতে পারেননি। বাড়ির যে অংশে অরবিন্দবাবুদের থাকার কথা ছিল, সেই অংশে ভাড়াটে বসানো ছিল। এই পারিবারিক তিক্ততার প্রভাব পড়ে পার্থ ও দেবযানীর মধ্যে। অনেক লড়াই-ঝগড়ার পরে ১৯৯৫ সালে রবিনসন স্ট্রিটের একতলায় তুলনায় ছোট একটি ফ্ল্যাটে জায়গা হয় অরবিন্দবাবুদের। সেখানে দশ বছরের বেশি সময় থাকেন অরবিন্দবাবুরা। ছোট জায়গা নিয়ে অশান্তি, ঝামেলা চলতে থাকে। মাঝে আরতিদেবী দুই পরিবারের সম্পর্ক ভাল করার ব্যাপারে উদ্যোগী হন। তার পরে ভাড়াটে তুলে ২০০২ সাল নাগাদ দোতলায় উঠে আসেন অরবিন্দবাবুরা। ২০০৫ সালে আরতিদেবী মারা যাওয়ার পরে সম্পর্ক ফের তিক্ত হয়। অরবিন্দবাবু, পার্থ ও দেবযানী নিজেদের বন্দি করে নেন ঘরে।
পরবর্তী পর্যায়ে আবার অরুণবাবুর সঙ্গে হাত মিলিয়েই সম্পত্তি বিক্রি করার পরিকল্পনা করেন অরবিন্দবাবু। এই নিয়ে তাঁর সঙ্গে বিরোধ বাধে পার্থ ও দেবযানীর। বাবা হয়তো সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে পারেন, এমন আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল তাঁদের। স্বভাবে লাজুক, অন্তর্মুখী দেবযানী ততটা বিরোধিতা না করলেও খেপে ওঠেন পার্থ। পুলিশের এক কর্তার কথায়, ‘‘কাকার সঙ্গে বাবার সংস্রব মানতে চাননি পার্থ। বহু বুঝিয়েও অরবিন্দবাবু ছেলেকে শান্ত করতে পারেননি।’’ একই ফ্ল্যাটের ভিতরে তখন একটি ঘরে ঢুকে পড়েন পার্থ ও দেবযানী, অন্য ঘরে অরবিন্দবাবু। চিরকুট মারফত তাঁদের কথা হতো। পুলিশের অনুমান, বাবার সঙ্গে বিরোধকে কেন্দ্র করেই দেবযানীর অনশনের সূত্রপাত। বাড়িতে শান্তি ফেরাতেই উপোস করছিলেন দেবযানী। শেষের দিকে তাঁর শরীর হাড়-জিরজিরে হয়ে যায়। এই অবস্থায় দেবযানীর মৃত্যুর পরে তাঁর দেহ শোওয়ার ঘরে রেখে প্রায় পনেরো দিন পার্থ ড্রয়িং রুমে ছিলেন। প্রথম দিকে তখন বেশি গন্ধ বেরোচ্ছিল বলে পার্থ পুলিশকে জানিয়েছেন। বাড়ির নিরাপত্তারক্ষীরা পুলিশকে জানিয়েছে, রক্ষীদের অনেকেই পচা গন্ধ পেয়েছিলেন। কিন্তু ফ্ল্যাটের ভিতরে ঢোকার অনুমতি ছিল না তাঁদের। তবে কয়েক মাস আগে পার্থর চর্মরোগ সারাতে এক হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক বাড়িতে এসেছিলেন। তিনি গন্ধ পাননি।
মঙ্গলবার দেবযানী বিষয়ে জানতে কলকাতা পুলিশের দু’জন অফিসার দক্ষিণেশ্বরের যোগদা সৎসঙ্গ আশ্রমে যান। আশ্রমের এক প্রবীণ সন্ন্যাসী বলেন, ‘‘শেষ দশ বছর দেবযানী যোগাযোগ না রাখলেও তিনি কিছু না জানানোয় তাঁর ফাইল বন্ধ করা হয়নি। তবে পার্থবাবু যোগাযোগ রাখতে চান না বলে জানানোর পরে তাঁর ফাইলটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।’’