একা ইঁদুর নয়, ধসের কারণ সড়ক সংস্কারে জোড়াতালিও

একের পর এক ধস। প্রতি বারই অভিযুক্ত মূষিক বাহিনী। শহরের মাটির নীচে তাদের রাজত্ব ক্রমশ বেড়ে চলছে। আর সেই কারণেই এই বিপত্তি বাড়ছে বলে মনে করছেন পুর ও পূর্ত কর্তারা। সম্প্রতি শহরের বিভিন্ন প্রান্তের রাস্তায় দশটি ধসের কারণ খুঁজলে দেখা যাবে অনেকাংশেই দায়ী ইঁদুর।

Advertisement

শান্তনু ঘোষ

শেষ আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০১৪ ০২:০৫
Share:

একের পর এক ধস।

Advertisement

প্রতি বারই অভিযুক্ত মূষিক বাহিনী। শহরের মাটির নীচে তাদের রাজত্ব ক্রমশ বেড়ে চলছে। আর সেই কারণেই এই বিপত্তি বাড়ছে বলে মনে করছেন পুর ও পূর্ত কর্তারা।

সম্প্রতি শহরের বিভিন্ন প্রান্তের রাস্তায় দশটি ধসের কারণ খুঁজলে দেখা যাবে অনেকাংশেই দায়ী ইঁদুর। ঢাকুরিয়া সেতুর কাঠামো নাড়িয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে সেতুর সামনের রাস্তা, টালিগঞ্জ সার্কুলার রোড, খিদিরপুর, স্ট্র্যান্ড রোড, বি কে পাল অ্যাভিনিউ, এসপ্ল্যানেড ইস্ট-সহ বিস্তীর্ণ অংশের রাস্তায় ধস নামার কারণ ছিল ইঁদুর। মঙ্গলবার নতুন জায়গা হিসেবে সংযোজিত হল চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ।

Advertisement

কিন্তু রাস্তায় ধসের একমাত্র কারণ ইঁদুরের তাণ্ডব এ তথ্য মানতে নারাজ রাস্তা বিশেষজ্ঞদের একাংশ। তাঁদের কথায়, “ইঁদুরের উৎপাত যেমন একটা কারণ, তেমনই রাস্তা সংস্কারে সংশ্লিষ্ট দফতরের তড়িঘড়ি কাজ করার মানসিকতাও অবশ্যই আর একটি কারণ।” তাঁদের মতে, নিকাশি, জলের পাইপলাইন কিংবা অন্যান্য কাজের জন্য রাস্তা খোঁড়া হয়। তার পরে কোনও মতে মাটি ফেলে তড়িঘড়ি গর্ত বুজিয়ে ফেলা হয়। কিছু দিন এ ভাবে চলার পরে সেখানে পিচ করে দেওয়া হয়। কিন্তু সেই কাজের সময়ে কখনওই দেখা হয় না রাস্তাটি কতটা চাপ সহ্য করতে পারবে, পরবর্তী কালে ভারী গাড়ির চাপে ফের ফাটল ধরবে কি না।

পুরসভার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের মেয়র পারিষদ অতীন ঘোষও মানছেন, “ইঁদুর তো আছেই। তবে যানবাহনের চাপের কথা মাথায় রেখে রাস্তার কোনও অংশ খোঁড়ার পরে কিংবা বসে গেলে তড়িঘড়ি তা সারাতে হয়। তখন যে পরিমাণ সময় দিয়ে রাস্তা সারানো উচিত, তা দেওয়া সম্ভব হয় না। অনেক ক্ষেত্রেই জোড়াতাপ্পি দিয়ে কাজ সারতে হয়। সেই কারণেও পরবর্তীকালে বহু সময়ে রাস্তায় ধস নামতে পারে। তাই উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে রাস্তা মেরামতির পরিকল্পনা করা হচ্ছে।”

দুর্গাপুরের একটি বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যাপক তথা রাস্তা বিশেষজ্ঞ অলোক সরকারও বলেন, “রাস্তায় ম্যাস্টিক অ্যাসফল্ট করতে ১১০ থেকে ১২০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় পিচ গলাতে হয়। তা না হলে পিচের বাঁধন ক্ষমতা কমে যায়। ফলে ভারী গাড়ির চাপে সেই রাস্তায় প্রথমে চিড় ধরে। যা থেকে জল চুঁইয়ে ভিতরে ঢুকে একেবারে নীচ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। যার জেরে পিচের নীচে থাকা বোল্ডার বা পাথর স্থানচ্যুত হয়, ক্ষয়েও যায়। পরবর্তী সময়ে সেখান থেকেই ফাটল হয়ে ধস নামে।”

পূর্ত দফতরের কর্তাদের একাংশ একবাক্যে স্বীকার করে নিচ্ছেন, “যে ভাবে তড়িঘড়ি কাজ সারতে হয়, তাতে এত নিয়ম মানা সম্ভব নয়।”

বর্ষার সময়ে কাজের ফলেও রাস্তার মান খারাপ হয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞেরা। অলোকবাবু বলেন, “প্রতিটি রাস্তারই চার-পাঁচটি স্তর থাকা উচিত। তার উপরে ম্যাস্টিক অ্যাসফল্ট করা দরকার। তা হলে রাস্তা মজবুত হয়।” কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই এই পদ্ধতি না মানায় সমস্যা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এখানে কাজের নিম্ন মানের সঙ্গে ইঁদুরের দৌরাত্ম্যের সম্পর্ক রয়েছে। রাস্তার নীচে ইঁদুরের বাসা থাকায় মাটি আলগা হয়ে যায়। ফলে টানা বৃষ্টিতে পিচ নরম হয়ে গেলে গাড়ির চাপে ফাটল ধরে। সেখান দিয়ে জল ঢুকে গর্তে জমা হয়। তা থেকেই পরে ফাটল সৃষ্টি হয়।

ধস আটকাতে যেমন কাজের মানোন্নয়নের কথা বলছেন রাস্তা বিশেষজ্ঞেরা, তেমনই উন্নত পদ্ধতি ব্যবহার করে এই মূষিককুলকে নিয়ন্ত্রণের কথা বলছেন প্রাণী বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, সাধারণ বিষে কলকাতার মাটির নীচে থাকা মেঠো ইঁদুরকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। কারণ, জিনগত ভাবে ওই বিষ ইঁদুরের ধাতে সয়ে গিয়েছে। ফলে বিষ খেয়েও ১০০টির মধ্যে প্রথমে ৪০টি ইঁদুর মারা যায়। বাকি ৩০টি প্রথমে ঝিমিয়ে থাকে। পরে কয়েকটি স্বাভাবিক হয়ে যায়, কয়েকটি মারা যায়। বাকি ৩০টির বিষ খেয়েও কিছুই হয় না।

ইঁদুর সমস্যা নিয়ন্ত্রণে প্রাণী বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ: “অ্যালুমিনিয়াম ফসফেট এক বিশেষ ধরনের ট্যাবলেট। যা ইঁদুরের গর্তে ফেলে দিয়ে গর্তের মুখ চেপে বন্ধ করে দিতে হবে। ভিজে মাটির সংস্পর্শে এসে ওই ট্যাবলেট গলে যে গ্যাস তৈরি হবে, তাতে একসঙ্গে অনেক ইঁদুর মরে যাবে। এ ভাবেই ইঁদুরের বাড়বাড়ন্ত কমানো সম্ভব।” নতুন পদ্ধতি ব্যবহারের পাশাপাশি শহরের যেখানে সেখানে ডাস্টবিন রাখা কিংবা খাবারের উচ্ছিষ্ট ফেলা বন্ধ করা উচিত বলে মনে করেন প্রাণী বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে পুরকর্তাদের বক্তব্য: “পুরোটাই জন সচেতনতার অভাব।”

সিদ্ধিদাতার বাহনদের নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা নিয়ে অবশ্য ‘নো কমেন্টস’ এর পথেই হাঁটছেন পুরকর্তারা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন