শঙ্কায় ডাক্তার, আস্থা হারাচ্ছেন রোগী

ঘটনাটা শুনে এক প্রবীণ ডাক্তারের আক্ষেপ, ‘‘আগে রোগীর আত্মীয়েরা বলতেন, ‘ডাক্তারবাবু আপনি ভগবান। আপনার ভরসায় সব রইল।’ আর এখন চোখে চোখ রেখে বলেন, এক চুল এ দিক ও দিক হলে রক্ষা থাকবে না।’’

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭ ০০:৫১
Share:

বাইপাসের এক বেসরকারি হাসপাতাল। দিন কয়েক আগের কথা। রোগীকে ঢোকানো হয়েছে অপারেশন থিয়েটারে। হার্টের জটিল অস্ত্রোপচার। ডাক্তারবাবু ওটি-তে ঢোকার মুখে রোগীর বাড়ির লোকেদের সঙ্গে দেখা। তিনি বলতে গেলেন, ‘‘হয়ে গেলে আপনাদের খবর দেব।’’ কিন্তু বলার সুযোগ পেলেন না। তার আগেই রোগীর এক আত্মীয় ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘‘অনেক টাকা খরচ করে অপারেশন করাচ্ছি। ব্যাপারটা মাথায় রাখবেন।’’

Advertisement

ঘটনাটা শুনে এক প্রবীণ ডাক্তারের আক্ষেপ, ‘‘আগে রোগীর আত্মীয়েরা বলতেন, ‘ডাক্তারবাবু আপনি ভগবান। আপনার ভরসায় সব রইল।’ আর এখন চোখে চোখ রেখে বলেন, এক চুল এ দিক ও দিক হলে রক্ষা থাকবে না।’’

যদিও রাতারাতি মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে, ব্যাপারটা মোটেই তা নয়। ধিকিধিকি আগুন জ্বলছিলই। কিন্তু অনেকেই মনে করছেন, ২০১৭ গোটা পরিস্থিতিকে এক ধাক্কায় অনেকটা নীচে নামিয়ে দিয়েছে। চিকিৎসক-রোগী সম্পর্কে বড় হয়ে উঠেছে পারস্পরিক অবিশ্বাস। বহু রোগী ডাক্তারের কাছে পৌঁছনোর আগেই ধরে নিচ্ছেন, ‘‘এই লোকটা আমাকে ঠকানোর প্রাণপণ চেষ্টা করবে।’’ আর ডাক্তারও হয়তো রোগীর বুকে স্টেথো ঠেকাতে ঠেকাতে ভাবছেন, ‘‘যে কোনও মুহূর্তে এ দলবল নিয়ে আমার উপরে চড়াও হবে।’’ ডাক্তার-রোগী সম্পর্কের নিরিখে এই বছরটা বড় বেশি অবিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে। নতুন বছরে কী ভাবে সেই অবিশ্বাস থেকে বেরিয়ে আসা যায়, তারই দিশা খুঁজছেন চিকিৎসক, রোগী, হাসপাতাল কর্তা— সব পক্ষই।

Advertisement

গত ১১ মাসে চিকিৎসকদের উপরে হামলার ৭০টি ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। হাসপাতালে ভাঙচুর, চিকিৎসকদের মারধর, এমনকী চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ তুলে চিকিৎসকের গায়ে বিষ্ঠা মাখানোর মতো ঘটনাও ঘটেছে।

সূত্রপাতটা হয়েছিল বছরের গোড়ার দিকে। ফেব্রুয়ারিতে টাউন হলে বেসরকারি হাসপাতালগুলির কর্তাদের বৈঠকে ডাকেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। হাসপাতালগুলির বিরুদ্ধে অনর্থক বিল বাড়ানোর যে সব অভিযোগ ওঠে, তা যে ভিত্তিহীন মনে করেন না তিনি, সরাসরি সে কথা জানিয়ে দেন। তাঁর হুঁশিয়ারির লক্ষ্য থেকে বাদ যাননি চিকিৎসকেরাও। ঘটনাচক্রে এর পরেই রাজ্যে একের পর এক হাসপাতালে হামলা এবং চিকিৎসক নিগ্রহের ঘটনা ঘটতে শুরু করে। কলকাতার অ্যাপোলো হাসপাতালে সঞ্জয় রায় নামে এক রোগীর মৃত্যু এবং হাসপাতালের বিপুল বিলকে ঘিরে তেতে ওঠে গোটা রাজ্য। বেসরকারি হাসপাতালগুলির উপরে নিয়ন্ত্রণে সরকারি তরফে তৈরি হয়ে যায় ‘হেল্থ রেগুলেটরি কমিশন’।

প্রশ্ন উঠেছে, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কি এ ভাবে সরাসরি হাসপাতালগুলিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো প্রয়োজন ছিল? তিনি কি হাসপাতালগুলিকে ডেকে আলাদা ভাবে সতর্ক করতে পারতেন না? স্বাস্থ্যকর্তাদের একটা বড় অংশের মতে, প্রয়োজন ছিল। মুখ্যমন্ত্রীর ওই বৈঠকের পরে বেসরকারি হাসপাতালগুলি যে কিছুটা হলেও সতর্ক হয়েছে, তা
বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এর উল্টো দিকও আছে। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে যথেচ্ছাচারও চলছে। বহু জায়গাতেই বিল না মিটিয়ে স্রেফ হাসপাতালকে হুমকি দিয়ে রোগীকে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন পরিজনেরা। তুচ্ছ ঘটনায় হামলা করছেন ডাক্তারদের উপরে।

অনেকেই বলছেন, প্রশাসনিক স্তর থেকে ওই পদক্ষেপই রোগী আর ডাক্তারদের যুযুধান দুই গোষ্ঠীতে পরিণত করেছে। এটা কাম্য ছিল না। এ ক্ষেত্রে একটা ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা খুবই জরুরি ছিল। কারণ, এই অবিশ্বাসের জেরে ডাক্তার-রোগী সম্পর্কের যে ভাবে অবনতি ঘটছে তার ফল ভোগ করছেন রোগীরাও। কারণ, ঝুঁকির অস্ত্রোপচারে রাজি হচ্ছেন না বহু ডাক্তার। জটিল রোগে অন্যত্র রেফার করে দায় এড়াচ্ছেন তাঁরা।

তবে তাঁদের অনেকের মধ্যেই যে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে, সে কথা মেনে নিয়েছেন বেসরকারি হাসপাতালের কর্তাদের একটা বড় অংশই। বেসরকারি হাসপাতালগুলির সংগঠন ‘অ্যাসোসিয়েশন অব হসপিটালস অব ইস্টার্ন ইন্ডিয়া’র তরফে রূপক বড়ুয়া বলেন, ‘‘বিভিন্ন ঘটনা থেকে আমরাও শিক্ষা নিচ্ছি। বহু ক্ষেত্রেই আমরা রোগীর বাড়ির লোকেদের কোনও কিছুই বোঝাই না। এ থেকেই যাবতীয় ভুল বোঝাবুঝি। চিকিৎসায় ১০ টাকাই খরচ হোক বা ১০০
টাকা, খরচের কারণটা স্পষ্ট ভাবে বোঝানো দরকার।’’

ডাক্তারদের অনেকেই মনে করেন, বহু ক্ষেত্রে হাসপাতালের এই অস্বচ্ছতার দায়টাই বর্তাচ্ছে তাঁদের উপরে। সরকারি চিকিৎসক তথা ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টর্স ফোরাম’-এর তরফে রেজাউল করিমের মতে, রাজনৈতিক স্তর থেকে কড়া বার্তা দেওয়া জরুরি যে, ডাক্তারদের মেরে কোনও সমস্যার সমাধান হবে না।

কিন্তু রাজনৈতিক স্তর থেকে কেন এই বার্তা দিতে হবে? তাঁর মতে, খোদ মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ্যে চিকিৎসকদের একটা অংশের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করার পরেই সাধারণ মানুষের মধ্যে অস্থিরতা, অবিশ্বাস বেড়েছে। এটা কমানোর দায়ও তাই রাজনীতির মঞ্চ থেকেই আসা জরুরি।

আর তাঁদের, অর্থাৎ ডাক্তারদের দায়িত্বটা কী হবে? ডাক্তারবাবু হেঁটে যাচ্ছেন দ্রুত গতিতে। আর রোগীর বাড়ির লোক তাঁর পিছনে দৌড়চ্ছেন শুধু রোগীর শারীরিক অবস্থাটুকু জানবেন বলে— এই ছবি তো সকলেরই চেনা। সেটায় কোনও বদল প্রয়োজন নেই? রেজাউল বলেন, ‘‘অবশ্যই আছে। ডাক্তারদের সংবেদনশীলতা বাড়ানোটা খুবই জরুরি। যতই দুরারোগ্য অসুখ হোক না কেন, ডাক্তার যদি রোগীকে
এটা বোঝাতে সক্ষম হন যে ‘আমি আপনার পাশে আছি’, তা হলে পরিণতি যা-ই হোক, কেউ ডাক্তারের উপরে চড়াও হবেন না।’’

মজার বিষয় হল, দু’তরফই নিজেদের সমস্যার দিকগুলো চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু শুধু চিহ্নিত করলেই কি তা থেকে বেরোনো সম্ভব? নতুন বছর এই প্রশ্নের কী উত্তর দেয়, সেই দিকেই তাকিয়ে সাধারণ মানুষ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন