গুলির জবাবে ফেসবুকে ক্ষোভ উগরে দিচ্ছে পুলিশ

কলকাতা বন্দর এলাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ থানার ওসি তিনি। শাসক দল তথা সরকারের বিরুদ্ধে অহরহ সুর চড়ান, এমন অভিযোগও তাঁর সম্পর্কে কোনও দিনই নেই। কিন্তু শনিবারের পুরভোটের পরে সেই তিনিই ফেসবুকে যে ‘পোস্ট’ করেছেন, তাতে ঠিকরে পড়ছে ক্ষোভের আগুন। আর সেই পোস্ট-এর সমর্থনে ‘লাইক’ আর ‘কমেন্ট’ নিয়ে যে ভাবে এগিয়ে এসেছেন অন্য অফিসারেরা, তাতে রীতিমতো বিদ্রোহের মেজাজই ফুটে বেরোচ্ছে কলকাতা পুলিশে।

Advertisement

সুরবেক বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:২৮
Share:

রবিবার অস্ত্রোপচারের জন্য ওটি-তে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আহত এসআই জগন্নাথ মণ্ডলকে। — নিজস্ব চিত্র।

কলকাতা বন্দর এলাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ থানার ওসি তিনি। শাসক দল তথা সরকারের বিরুদ্ধে অহরহ সুর চড়ান, এমন অভিযোগও তাঁর সম্পর্কে কোনও দিনই নেই। কিন্তু শনিবারের পুরভোটের পরে সেই তিনিই ফেসবুকে যে ‘পোস্ট’ করেছেন, তাতে ঠিকরে পড়ছে ক্ষোভের আগুন। আর সেই পোস্ট-এর সমর্থনে ‘লাইক’ আর ‘কমেন্ট’ নিয়ে যে ভাবে এগিয়ে এসেছেন অন্য অফিসারেরা, তাতে রীতিমতো বিদ্রোহের মেজাজই ফুটে বেরোচ্ছে কলকাতা পুলিশে।

Advertisement

শনিবার সন্ধে সাড়ে সাতটা। গিরিশ পার্কে সাব ইনস্পেক্টর জগন্নাথ মণ্ডল গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর তিন ঘণ্টা কেটে গিয়েছে। বন্দর এলাকার ওসি নিজের ফেসবুক দেওয়ালে লিখলেন— ‘পুলিশই কেন সব সময়ে সব রাজনৈতিক দলের শিকার হবে? ভোটারদের নিরাপত্তা এবং ভোটযন্ত্র ও ভোটকর্মীদের সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্বে ছিলেন আমাদের এক জন অফিসার। কিন্তু বিনিময়ে তিনি পেয়ে গেলেন তাঁর জীবনের সব চেয়ে দামি উপহার— একটি বুলেট!’

গত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ওই পোস্ট-এ ৯০টি ‘লাইক’ পড়ে গিয়েছে। যাঁরা ‘লাইক’ করেছেন, তাঁদের একটা বড় অংশ কলকাতা পুলিশের অফিসার। পোস্টটির নীচে চোখা মন্তব্য করেছেন ৪৭ জন। তাঁদের মধ্যেও পুলিশ আধিকারিকের সংখ্যা কম নয়। কলকাতার পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ করপুরকায়স্থ অবশ্য এই বিক্ষোভ-বিদ্রোহের ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লালবাজারের অন্য এক শীর্ষকর্তা রবিবার খবরটা শুনে বলেন, ‘‘তাই নাকি! আমাদের অফিসাররা এমন মন্তব্য করেছেন! দেখতে হবে তো! পরিস্থিতি তো ভাল ঠেকছে না।’’

Advertisement

বাস্তবিকই ওসি-র চেয়ারে বসে কোনও পুলিশ অফিসার সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে শাসক দলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন, এমন নজির এ রাজ্যে প্রায় নেই বললেই চলে। সেই সঙ্গে দেখা যাচ্ছে, ওই ওসি একা নন! তাঁর আগুন ঝরা পোস্ট-এ গলা মেলাচ্ছেন অন্য অফিসাররা। এটাও কম বেনজির ঘটনা নয়। ওই অফিসারেরা প্রত্যেকেই নিজেদের আসল পরিচয় দিয়ে ওই সাইটে প্রোফাইল খুলেছেন। ফলে পরিচয় গোপন করার ব্যাপার নেই। এই অবস্থায় সরাসরি সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খোলার ঝুঁকি না নিতেই পারতেন তাঁরা। অনেক সময়ে বহু অফিসার সাংবাদিকদের সঙ্গে ‘অফ দ্য রেকর্ড’ বলা কথায় অনেক ক্ষোভ উগরে দেন। কিন্তু ফেসবুকে মন্তব্য করলে সেটা আর ‘অফ দ্য রেকর্ড’ থাকে না। এ রাজ্যে ইন্টারনেটে নিজের মত প্রকাশ করে বা রঙ্গব্যঙ্গে অংশ নিয়ে সরকারের কোপে পড়ার একাধিক দৃষ্টান্ত রয়েছে। প্রশাসনের নির্দেশে পুলিশই সেখানে মন্তব্যকারীর হাতে হাতকড়া পরিয়েছে। এ বার কিন্তু পুলিশই নিজের ক্ষোভ প্রকাশেরমঞ্চ হিসেবে নেট-দুনিয়াকে বেছে নিল। স্বাভাবিক ভাবেই পুলিশের বড় কর্তারা এর মধ্যে একটা বেপরোয়া এবং স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহের সুর টের পেয়ে প্রমাদ গুনছেন। স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছেন, ‘‘পরিস্থিতি তো ভাল ঠেকছে না।’’

পরিস্থিতি যে ভাল নয়, সেটা পুলিশ মহলে কান পাতলেই বোঝা যাচ্ছে। শুধু নেট-দুনিয়া নয়, ব্যক্তিগত আলাপচারিতাতেও প্রকাশ পাচ্ছে একই রকম ক্ষোভের আঁচ। দু’বছর আগে গার্ডেনরিচে এসআই তাপস চৌধুরী নিহত হওয়ার পর পুলিশের মধ্যে যতটা ক্ষোভ মাথাচাড়া দিয়েছিল, বাহিনীর অনেকে এ বার তার চেয়েও বেশি ক্ষিপ্ত। কেন? লালবাজারের এক কর্তার ব্যাখ্যা, গার্ডেনরিচে ঘটনাচক্রে দু’পক্ষের গুলি বিনিময়ের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন তাপসবাবু। কিন্তু গিরিশ পার্কে একটাই পক্ষ ছিল। ভোট মেটার পরে শাসক দলের মদতপুষ্ট দুষ্কৃতীদের ৬০-৭০ জনের একটি বাহিনী মোট ৩০টি মোটরবাইকে সিংহিবাগানের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। এসআই জগন্নাথ মণ্ডল-সহ কয়েক জন পুলিশ সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বাইক থেকে প্রথমে চারটি বোমা ছোড়া হয়, তিনটি ফাটে। তার পরেই ইফতিকার নামে এক যুবক পিস্তল থেকে একটি গুলি ছোড়ে। যেটি লাগে জগন্নাথবাবুর গায়ে। লালবাজারের ওই অফিসারের কথায়, ‘‘এটা দু’পক্ষের লড়াইয়ের মধ্যে পড়ে গুলি খাওয়া নয়। শাসক দলের একতরফা তাণ্ডবের মুখে পড়ার ঘটনা।’’ একে শনিবার বহু জায়গায় শাসক দলের নির্বাচনী সন্ত্রাসের সামনে নিষ্ক্রিয় থাকার জন্য জনতার ছিছিক্কার, তার উপরে সেই শাসক দলেরই মদতপুষ্ট দুষ্কৃতীর বন্দুক থেকে এসআইয়ের গুলিবিদ্ধ হওয়া— পুলিশের একটা বড় অংশ ক্রোধ আর চেপে রাখতে পারছেন না। শনিবার যে ভাবে পুলিশের সামনেই শাসক দলের ক্যাডাররা অবাধে সন্ত্রাস চালিয়েছে বলে অভি়যোগ, যে ভাবে পুলিশকে আক্ষরিক অর্থেই জোড়হস্ত হতে দেখা গিয়েছে তৃণমূল নেতৃত্বের সামনে, যে ভাবে পুলিশ নীরবে দেখে গিয়েছে দুষ্কৃতীদের আস্ফালন— তাতে কলকাতাবাসীও পুলিশের উপরে আর কোনও আস্থাই খুঁজে পাচ্ছেন না। রবিবার নাগরিক আলোচনায় বারবারই উঠে এসেছে সে প্রসঙ্গ। দক্ষিণ কলকাতার বাজারে এক ক্রেতা আর এক ক্রেতাকে জিজ্ঞেস করেছেন, ‘‘আচ্ছা, গতকাল ভোটে কি সত্যিই পুলিশ ছিল? নাকি পুলিশের উর্দি পরিয়ে শাসক দলের লোকদের দাঁড় করানো হয়েছিল বুথে বুথে?’’ রেলের টিকিট কাউন্টারে বসা রেলকর্মীর প্রশ্ন ছিল, ‘‘ফালতু পুলিশ দেওয়ার দরকার কী ছিল? পুলিশেরও মুখ পুড়ল, সাধারণ মানুষও হতাশ হলো!’’

সাধারণ মানুষের হতাশার এই আঁচ পুলিশের কানে পৌঁছয়নি, তা নয়। সেই সঙ্গে চোখের সামনে আইন ভাঙা দেখেও চুপ করে থাকতে বাধ্য হওয়ার হতাশা পুলিশের নিজের মধ্যেও পাহাড়প্রমাণ হয়ে অনেক দিনই জমছে। পুলিশকে আক্রমণের মুখেও পড়তে হচ্ছে বারবার। কখনও ময়দানের সভায়, কখনও আলিপুর বা গড়ফা থানায় পুলিশকেই নিজের প্রাণ বাঁচানোর কথা ভাবতে হচ্ছে। পুলিশের একাধিক কর্তাই স্বীকার করছেন— পুরভোটে তাঁরা যেন সক্রিয় না হন, সেই নির্দেশ প্রত্যক্ষ ভাবে তাঁদের উপরে ছিল। লালবাজারের একাধিক শীর্ষকর্তার বক্তব্য, পুলিশের যা আইনি অধিকার ও ক্ষমতা আছে, সে সব প্রয়োগ করার উপরে কার্যত নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল পুরভোটের দিন! তা ছাড়া গোয়েন্দা বিভাগের একাধিক অফিসার জানাচ্ছেন, শুধু ভোটের দিন সক্রিয় হলেই হয় না। এর একটা প্রস্তুতি আছে। রীতি অনুযায়ী ভোটের আগেই সমাজবিরোধীর তালিকা তৈরি করে তাদের একটা বড় অংশকে গ্রেফতার করতে হয়। এই পুরভোটের আগে এই তালিকা তৈরিই করা হয়নি। লালবাজারের একাধিক কর্তা স্বীকার করে নিচ্ছেন, সব সময় গ্রেফতারও করার দরকার পড়ে না। তালিকায় নাম আছে জানার সঙ্গে সঙ্গেই বহু দুষ্কৃতী ভিন রাজ্যে পালিয়ে যায়, কেউ কেউ আবার ঝুটঝামেলা এড়াতে ভোটের তিন-চার দিন আগে আপনা থেকে নিজেদের লালবাজারে ‘জমা করে’ এবং ভোট শেষ হওয়া পর্যন্ত সেখানেই থাকে। এ বারে সে সবের বালাই ছিল না।

কিন্তু এত কিছু হজম করার পরেও যে জগন্নাথবাবুকে গুলি খেতে হলো, এতেই ক্ষোভের বাঁধ ভাঙছে পুলিশ মহলে। উত্তর কলকাতার একটি থানার ইনস্পেক্টরের বক্তব্য, ‘‘উপর মহলের নির্দেশে তো আমরা সে ভাবে নড়াচড়া করিনি। তাতেও গুলি জুটল। সক্রিয় হলে তো অনেকেই খুন হয়ে যেতাম।’’ স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চ-এর এক সিনিয়র ইনস্পেক্টর বললেন, ‘‘বুলেট ছাড়া আর কী জুটবে? প্রশাসনের শীর্ষ মহল আর নেতাদের নির্দেশে পুরভোটে দিনভর যে-রকম লাগামছাড়া সন্ত্রাস বরদাস্ত করতে হল, তাতে দিনের শেষে এটাই প্রাপ্য ছিল।’’

প্রায় একই আক্ষেপ ২০০৬-এর জুলাই মাসে শোনা গিয়েছিল এক অফিসারের কাছে। তদানীন্তন শাসক দল অর্থাৎ বামফ্রন্টের মদতপুষ্ট একদল মস্তান তাঁকে বেধড়ক মারধর করছিল রাজাবাজার তল্লাটে। ওই অফিসার এখন দক্ষিণ শহরতলির একটি থানার ওসি। তখন সাব-ইনস্পেক্টর পদাধিকারী ওই অফিসার বলেছিলেন, ‘‘উত্তর-পূর্ব কলকাতার আসনে ওরা যাতে জিততে পারে, সেই জন্য ওদের খুল্লম খুল্লা ছাপ্পা ভোট দিতে দেখেও কিছু বলিনি। আর আমারই গায়ে ওই পার্টির লোকজন হাত তুলল! এর শোধ আমি নেব।’’

২০১৫। গিরিশ পার্কে জগন্নাথ মণ্ডলের গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর ঠিক একই সুরে একাধিক ওসি বলছেন, ‘‘জনতার গালি, দুষ্কৃতীদের গুলি, সবই তো খাচ্ছি আমরা। এ বার কিন্তু বাহিনী বিদ্রোহ করবে।’’

আর, অন্য দিকে আরও তটস্থ হয়ে যাচ্ছেন তাঁরা, যাঁদের আগামী ২৫ তারিখ ডিউটি রয়েছে ভোটের। হুগলিতে ডিউটি পাওয়া এক সিআইডি অফিসারের বক্তব্য, কলকাতায় যেখানে এই অবস্থা, জেলায় তো শাসক দলের মদতপুষ্ট দুষ্কৃতীরা আরও অনেক বেশি বেপরোয়া হবে। ওই অফিসারের কথায়, ‘‘লজ্জা হচ্ছে খুবই। তবে প্রাণের ভয় অনেক বেশি। ২৫ তারিখ আমি কোনও নড়াচড়াই করব না। সাধ করে কেন গুলি খেতে যাব?’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন