(১) বেলঘরিয়া প্রফুল্লনগর। (২) নিমতার মানিকপুর বাসস্টপের কাছে। (৩) বিমানবন্দর থানার কাছে। (৪) বাগুইআটির কাছে। — শৌভিক দে
রাত ১১টা ২০ মিনিট। বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ের খালিসাকোটার দিক থেকে তীব্র গতিতে ছুটে আসছে গরু-বোঝাই একটি লরি। এয়ারপোর্ট তিন নম্বর গেটের সামনে অন্ধকারের বুক চিরে আচমকাই রাস্তার মাঝখানে লাফিয়ে পড়ল চার ছায়ামূর্তি। সাদা আলোর টর্চ নাড়িয়ে লরিটিকে থামানোর মরিয়া চেষ্টা করলেও কোনও বাধা না মেনে সেটি ঊর্ধ্বশ্বাসে বেরিয়ে গেল। তবে যাওয়ার সময়ে রাস্তায় কিছু একটা ছুড়ে দিয়ে গেলেন লরির খালাসি। আর সেটাই কুড়িয়ে নিয়ে ফের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল ছায়ামূর্তিরা। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই আর একটি লরি আসতেই আবার একই কাণ্ড। তবে এ বার অবশ্য আর পালানোর পথ পেল না সেই লরিটি। এক প্রকার লাফিয়ে চালকের কেবিন থেকে ‘প্রণামী’ আদায় করে ছাড়লেন ওই পুলিশকর্মীরা!
রাত সওয়া ১২টা। এক্সপ্রেসওয়ের বিমানবন্দরমুখী রাস্তার মানিকপুর বাসস্টপের সামনে দাঁড়িয়ে পুলিশের টহলদারি গাড়ি। গাড়ির সামনের আসনে এক ব্যক্তি। বাকি তিন যুবক (প্রত্যেকেই জলপাই রঙের পোশাকে) টর্চ হাতে রাস্তার উপরে দাঁড়িয়ে। লরি দেখলেই আলোর ইশারায় দাঁড় করিয়ে আদায় করা হচ্ছে টাকা।
রাত পৌনে ১টা নাগাদ ফের ফিরে আসা হল ওই একই জায়গায়। টহলদারি গাড়ির সামনে গিয়ে জানতে চাওয়া হল, ‘‘কোন থানা?’’ জলপাই রঙের পোশাক পড়া এক যুবকের জবাব, ‘‘নিমতা থানা। কেন বলুন তো?’’ কিন্তু ওই জায়গা কি নিমতা থানার এলাকার মধ্যে? প্রশ্নটা করতেই ফের ওই যুবক বললেন, ‘‘না, না! আমরা ব্যারাকপুর কমিশনারেটের রেডিও ফ্লাইং স্কোয়াড।’’ এর মধ্যেই গাড়ি থেকে নেমে এলেন আরএফএস-র দায়িত্বে থাকা এএসআই। বললেন, ‘‘এক ঘণ্টা ধরে নাকা চেকিং চলছে। চার চাকা, দু’চাকা, লরি সব চেকিং করছি। কন্ট্রোল রুমে রিপোর্ট দিলাম, ২২টা গাড়ি চেকিং করেছি।’’ কিন্তু রাত সওয়া ১২টা থেকে পরপর দু’বার ওই গাড়ির সামনে দিয়ে ঘোরা হয়েছে। একবারের জন্যও তো আটকায়নি কেউ!
চুপ করে থাকলেন ওই অফিসার। এর পরেই তাঁকে ক্যামেরায় তোলা ছবি (জলপাই রঙের পোশাক পরা এক যুবক লাফিয়ে খড়-বোঝাই একটি লরির খালাসির হাতে হাত মেলাচ্ছেন) দেখাতেই তিনি বলে উঠলেন, ‘‘স্যার, ভুল হয়ে গিয়েছে।’’
রাত ১টা ১০ মিনিট। প্রফুল্লনগর বাসস্টপের সামনে দাঁড়িয়ে নীল রঙের পুলিশ জিপ। গাড়িটির নম্বর প্লেট অর্ধেক ভাঙা। মাল-বোঝাই লরি দেখলেই ওই গাড়ির আরোহীরাও অন্যদের মতো একই ভাবে টর্চ দেখিয়ে লরি আটকাচ্ছেন। কিন্তু কোনও কাগজপত্র পরীক্ষার বদলে লরির খালাসির সঙ্গে হাত মিলিয়েই ছাড়পত্র দিয়ে দিচ্ছেন খাকি উর্দিপরা লোকেরা। বেশ কিছুক্ষণ ওই জিপের সামনে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও এক বারের জন্যও কেউ জানতে চাইলেন না, দাঁড়িয়ে থাকার কারণটা কী?
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরে নিজেরাই ফের এগিয়ে গিয়ে জানতে চাওয়া হল, ‘‘কোন থানা?’’ জিপের সামনের আসনে বসা খাকি উর্দির লোকটি সঙ্গে সঙ্গে টুপি পরে নিয়ে বললেন, ‘‘বেলঘরিয়া থানা। কেন বলুন তো?’’ গাড়ি পরীক্ষা করছেন কি না জানতে চাইতেই কথা না বাড়িয়ে ওই অফিসার রাস্তায় দাঁড়ানো যুবকদের গাড়িতে ওঠার নির্দেশ দিলেন। এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই এলাকা ছেড়ে বেরিয়ে গেল জিপটি। এর পরে অবশ্য রাত সাড়ে তিনটে পর্যন্ত গোটা এক্সপ্রেসওয়ের কোথাও ওই নীল জিপের দেখা মেলেনি।
রাত আড়াইটে। বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়েতে দক্ষিণেশ্বরগামী রাস্তার উপরে প্রমোদনগর এলাকায় দাঁড়িয়ে ‘পুলিশ’ লেখা একটি টাটা সুমো। তার সামনে দিয়েই নিয়ম ভেঙে এয়ারপোর্টের দিকে ছুটছে লরি ও অন্যান্য যানবাহন। ঊর্ধ্বশ্বাসে তীব্র গতিতে ছুটে চলেছে মোটরবাইক। এক-একটি বাইকে হেলমেটবিহীন তিন জন করে আরোহী। সে সব দেখেও দেখছেন না টাটা সুমোর পুলিশকর্মীরা। বেশ কিছুক্ষণ পরে এগিয়ে গিয়ে জানতে চাওয়া হল, ওই গাড়িগুলি নিয়ম ভেঙে কী ভাবে যাতায়াত করছে? কেনই বা সেগুলিকে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে না? সঙ্গে সঙ্গে গাড়িতে বসা অফিসারের দাবি, ‘‘কী করব বলুন! এই সব গাড়ি, মোটরবাইক ধরতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটলে তো পুলিশের দোষ হবে।’’
ভোর ৪টে ১৫ মিনিট। ভিআইপি রোডে পোদ্দারবিহার এবং হলদিরাম স্টপেজের সামনে দাঁড়িয়ে বিধাননগর কমিশনারেটের আরটি মোবাইল ভ্যান। যদিও সারা রাতে ওই রাস্তায় বেশ কয়েকবার চক্কর কেটেও কোনও পুলিশের গাড়ি চোখে পড়েনি। কিন্তু ভোরের আলো ফোটার সময়ে দেখা মিলল দু’টি টহলদারি গাড়ির। সেখানেও বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ের থেকে অন্য কোনও ছবি চোখে পড়ল না। একই ভাবে মুরগি, ফল-বোঝাই গাড়ি থেকে টাকা নিচ্ছে পুলিশ।
কী বলছেন স্থানীয় বাসিন্দা ও চালকেরা?
বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, রাস্তার অনেক জায়গাতেই বাতিস্তম্ভ থাকলেও তাতে আলো নেই। আবার রাস্তার ধারে সার দিয়ে সিন্ডিকেটের মালপত্র-বোঝাই লরি পার্কিং করা থাকে। কিন্তু সব কিছু জেনেশুনেও টহলদারি পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নেয় না। সব থেকে বিপজ্জনক অবস্থা এয়ারপোর্ট তিন নম্বর গেটের সামনে। এখান থেকেই একটি রাস্তা চলে গিয়েছে বারাসতের দিকে, অন্যটি এয়ারপোর্ট যাওয়ার জন্য সেতুতে উঠে গিয়েছে। কিন্তু রাস্তা এখান থেকে ভাগ হলেও কোনও আলো নেই। বাসিন্দাদের অভিযোগ, এর ফলে সেতুর ডিভাইডারে গাড়ি ধাক্কা মেরে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। এয়ারপোর্ট তিন নম্বর গেটের কাছের এক আবাসনের বাসিন্দা সমীরবরণ সাহা বললেন, ‘‘রাস্তায় আলো না থাকায় রোজই দুর্ঘটনা ঘটছে। মহিলারাও রাতে চলাফেরা করতে নিরাপত্তার অভাব বোধ করেন। বাধ্য হয়েই আমরা এবং উল্টো দিকের আবাসনের বাসিন্দারা হ্যালোজেন লাগিয়েছি। প্রতিদিন সন্ধ্যে থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত তা জ্বালিয়ে রাখি।’’ অন্য দিকে, প্রফুল্লনগরের বাসিন্দা সৌমেন আদক বললেন, ‘‘পুলিশ নির্দিষ্ট কয়েকটা জায়গা ছা়ড়া থাকে না। ফলে রাতে কিছু ঘটে গেলেও কেউ দেখার নেই।’’
শনিবার (১২ ডিসেম্বর) রাতে ঘোরার সময়েই এক্সপ্রেসওয়ের উপরে এক চায়ের দোকানে দেখা মিলল রহিম শেঠ নামে এক লরিচালকের। বললেন, ‘‘দক্ষিণেশ্বর থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত আসতেই পুলিশকে মোট ১০০ থেকে ১৫০ টাকা দিতে হয়। এর থেকে বেশি খরচ হলে মালিক আমাদের মাইনে থেকে কেটে নেন।’’ চালকদের আরও অভিযোগ, গরু বা যে কোনও পশু-বোঝাই লরিপিছু ৫০ টাকা আর অন্য গাড়ি হলে ১০ বা ২০ টাকা দিতে হয়।
পুলিশের বক্তব্য
ব্যারাকপুরের পুলিশ কমিশনার নীরজ সিংহের কথায়, ‘‘রাতে চেকিং-এর জন্য টহলদার গাড়িকে পাঠানো হয়। কিন্তু তা না করে যদি অন্য অন্যায় কাজ করেন, তা কোনও মতেই সমর্থনযোগ্য নয়। কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’ বিধাননগরের এডিসিপি (ট্রাফিক) শিবানী তিওয়ারি বলেন, ‘‘এ ধরনের কাজ মানা হবে না। খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’