(বাঁ দিকে) শুভেন্দু অধিকারী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (ডান দিকে)। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চমকপ্রদ ‘তৎপরতা’ কি বিরোধীদলকে ফের হতাশার দিকে ঠেলে দিল? যুবভারতী কাণ্ডের পরে এখনও সপ্তাহ ঘোরেনি। তার মধ্যেই বিজেপির প্রতিবাদ-বিক্ষোভ কার্যত মিইয়ে যাওয়ার পথে। হাওয়া গরম রাখতে বিরোধী দলনেতা নিজেও রাস্তায় নেমেছিলেন। কিন্তু তাতে রাজনীতি আদৌ সরগরম রইল কি না, তা নিয়ে অনেকের মধ্যেই সংশয় তৈরি হয়েছে। সৌজন্যে: মুখ্যমন্ত্রীর ‘ঝোড়ো ব্যাটিং’। পর পর চার দিনে চার পদক্ষেপ বিরোধী দলের ‘ভাষ্য’ ছিনিয়ে নিয়েছে বলেই তৃণমূলের দাবি।
লিয়োনেল মেসির সফর ঘিরে গত শনিবার যুবভারতীতে আয়োজিত অনুষ্ঠান ভেস্তে যাওয়ার অব্যবহিত পরেই মুখ্যমন্ত্রী মেসি এবং দর্শকদের কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমাপ্রার্থনা করেন। রাজ্য সরকার বা তৃণমূল অনুষ্ঠানের আয়োজক না-হওয়া সত্ত্বেও মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষমাপ্রার্থনার এমন ঘটনা বিরল। একইসঙ্গে প্রাক্তন বিচারপতিকে মাথায় বসিয়ে তদন্ত কমিটি গড়েন মমতা। পদক্ষেপ ‘যথেষ্ট নয়’ এবং ‘লোকদেখানো’ বলে বিজেপি হইচই জুড়তে না-জুড়তেই পরপর পদক্ষেপ করেন মমতা। প্রথমত, তদন্ত চলাকালীন ক্রীড়া দফতর থেকে মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের অব্যাহতি নেওয়ার ইচ্ছাপ্রকাশ তাতে মুখ্যমন্ত্রীর সিলমোহর। দ্বিতীয়ত, রাজ্য পুলিশের ডিজি এবং বিধাননগরের পুলিশ কমিশনারকে শোকজ়। এক ডেপুটি কমিশনারের নিলম্বন (সাসপেনশন)। রাজ্যের ক্রীড়াসচিবের শাস্তি, যুবভারতীর সিইও-র উপরেও শাস্তির খাঁড়া। সব শেষে অভিজ্ঞ আইপিএসদের নিয়ে ‘সিট’ গঠন। ঘটনার ঘটার পরে চার দিন অর্থাৎ, মঙ্গলবারের মধ্যে।
অতঃপর বুধবার দুপুরে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী আচমকাই হাজির হন যুবভারতীর প্রবেশপথে। সঙ্গে ছিলেন বিজেপির অন্য বিধায়করাও। তাঁরা মাঠে ঢুকতে পারেননি। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ সেখানে বিক্ষোভ দেখান। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর (মমতা) পদত্যাগ দাবি করেন। তৃণমূলের বিরুদ্ধে তোপ দেগে নেতা-মন্ত্রীদের গ্রেফতারিও দাবি করেন। বিধাননগর কমিশনারেটের প্রবেশপথের সামনে দাঁড়িয়ে পুলিশের বিরুদ্ধেও তোপ দাগেন। কিন্তু তার আগে মমতা প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। ফলে শুভেন্দু তথা বিরোধীদলের তূণে ‘অস্ত্র’ বলতে খুব একটা কিছু ছিল না। ঘটনার প্রেক্ষিতে শুভেন্দুরা যে সব পদক্ষেপের দাবি শুরু থেকে তুলছিলেন, সেগুলির মধ্যে শুধু অরূপ এবং সুজিত বসুর ‘গ্রেফতারি’ ছাড়া প্রায় সবই মুখ্যমন্ত্রীই করে দিয়েছেন। রাজ্য বিজেপির অনেকে একান্ত আলাপচারিতায় মেনেও নিচ্ছেন যে, অরূপ-সুজিতের গ্রেফতারির দাবি ‘কথার কথা’। গ্রেফতার করার মতো কোনও ‘অপরাধ’ তাঁরা আদৌ করেছিলেন কি না, তা তর্কসাপেক্ষ। সুতরাং, মুখ্যমন্ত্রী যে পদক্ষেপগুলি করেছেন, সেগুলিকে ‘লোকদেখানো’ বলে বর্ণনা করা ছাড়া বিজেপির এই মুহূর্তে আর কিছু বলার নেই। ঘটনাচক্রে, যে তিন পুলিশ আধিকারিককে শোকজ় করা হয়েছিল, তাঁদের জবাবও বুধবারেই জমা পড়ে গিয়েছে। কারণ, তাঁদের জবাব দেওয়ার জন্য ২৪ ঘন্টার সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল।
মমতার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দীর্ঘদিন কাছ থেকে দেখা শুভেন্দুও সম্ভবত বুঝেছেন, অনুষ্ঠান ভেস্তে যাওয়া ভুলে এখন আলোচনার কেন্দ্রে মমতার একাধিক প্রশাসনিক পদক্ষেপ। তাই তিনি নিজেই বিক্ষোভ দেখাতে পথে নামেন। তা নিয়ে কিছুক্ষণ হইচইও হয়। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহে নতুন করে আর কোনও ঢেউ ওঠেনি। বিজেপির পালে নতুন হাওয়ার কোনও লক্ষণও দেখা যায়নি। তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষের কথায়, ‘‘সকলেই জানেন, সিপিএম জমানায় এ রকম ঘটনা ঘটলে কোনও তদন্তই হত না। কুম্ভমেলায় মৃত্যুমিছিলের পরে বিজেপির কোনও মন্ত্রী ইস্তফা দিতে চাননি, সেও সকলেই দেখেছেন।’’ কুণাল বলছেন, ‘‘একটা বাজে ঘটনা ঘটেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিন্দা করেছেন, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় নিন্দা করেছেন, আমরা সবাই নিন্দা করেছি। তার পরে প্রশাসনিক পদক্ষেপও করা হয়েছে। অতএব বিজেপি আর পালে হাওয়া টানতে পারল না।’’
প্রসঙ্গত, বুধবার রাতে দিল্লি থেকে কলকাতায় ফিরে অভিষেক স্পষ্টই জানান, কয়েকজনের আচার-আচরণ, আদিখ্যেতার জন্যই যুবভারতীতে মেসির অনুষ্ঠানে গোলমাল হয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘এই ঘটনা আমরা কেউ চাইনি। আন্তর্জাতিক স্তরে বাংলার মানহানি হয়েছে। কয়েকজনের আচার-আচরণে বাংলার মাথা হেঁট হয়েছে। এটা কখনওই কাম্য ছিল না।’’ পাশাপাশিই অভিষেক বলেছেন, ‘‘একাংশের গাফিলতিতেই বলুন বা আয়োজকদের গাফিলতিতেই হোক ওই ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ-প্রশাসনের তরফেও শিথিলতা ছিল। তা নিয়ে ইতিমধ্যেই তদন্ত হচ্ছে। আয়োজক, প্রশাসন, এমনকি, রাজ্য মন্ত্রিসভার সদস্য, যিনিই হোনা না কেন, সকলকেই জবাবদিহি করতে হবে।’’
প্রায় একই সময়ে নেতাজি ইন্ডোরে ব্যবসায়ীদের সম্মেলনে ভাষণ দিতে গিয়ে কারও নাম নাকরলেও মমতা বলেন, তিনি ‘দুষ্টু-মিষ্টি মেডিসিন’ দিয়ে সমস্যার সমাধান করার কথা বলেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘আমাদের কেউ যদি দুষ্টুমি করে, তা হলে আমিও দুষ্টু-মিষ্টি ওষুধ দিয়ে সমস্যা সমাধান করে দিই বা সমাধানের চেষ্টা করি।’’ একইসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘আমি কিছুদিন আগে মুর্শিদাবাদ সফরে গিয়েছিলাম। সেখানে একটা মেলা হচ্ছিল। আমি যাব ভেবেছিলাম। জানতাম, আমি গেলে ছবি তোলার জন্য ভিড় হবে। বাপরে বাপ! কী ভিড়! সেদিন আর সেখানে ঢুকতে পারিনি।’’ যুবভারতীতে মেসিকে ঘিরে ছবি তোলানোর ভিড়ের প্রতিই যে মুখ্যমন্ত্রীর ইঙ্গিত ছিল, তা স্পষ্ট।
অর্থাৎ, শাসক শিবিরের দুই শীর্ষনেতা— মমতা এবং অভিষেক, দু’জনেই ওই ঘটনায় কড়া পদক্ষেপ করেছেন এবং বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, তাঁরা নিজের প্রশাসন এবং দলকে রেয়াত করছেন না। যা বিরোধীদলের আন্দোলন স্তিমিত করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।
বিজেপি অবশ্য বলছে, যুবভারতী কাণ্ডকে কাজে লাগিয়ে আলাদা ‘রাজনৈতিক লাভ’ পাওয়া গেল কি না, তা নিয়ে দল আদৌ ভাবিত নয়। বিধানসভায় বিরোধীদলের মুখ্য সচেতক শঙ্কর ঘোষের কথায়, ‘‘এই সরকারের ভাবমূর্তি যেখানে পৌঁছেছে, সেখানে নতুন করে ওদের মুখ পোড়ার কিছু নেই। মুখ এমনিতেই পুড়ে রয়েছে। তাৎক্ষণিক কিছু প্রসাধনী মাখিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই মুখ পরিষ্কার দেখানোর চেষ্টা করেছেন।’’ তিনি আরও বলছেন, ‘‘প্রত্যেকে জানেন, এটাই তৃণমূলের কৌশল। একটা বাজে ঘটনা ঘটলে ওদেরই কেউ তার নিন্দা করবে, কেউ পদক্ষেপ করবে। কিন্তু পুরো কর্মকাণ্ড শেষ পর্যন্ত একটা অশ্বডিম্ব প্রসব করবে। এ বারও যে তার কোনও অন্যথা হবে না, সে কথা সকলেই বুঝে গিয়েছেন।’’
বিজেপির ‘চেষ্টা’য় অবশ্য ত্রুটি নেই। বৃহস্পতিবারও বিজেপি যুবমোর্চা আবার পথে নামছে। সংগঠনের রাজ্য সভাপতি ইন্দ্রনীল খাঁয়ের নেতৃত্বে বিক্ষোভ মিছিল হচ্ছে দক্ষিণ কলকাতায়। শুভেন্দু-ঘনিষ্ঠরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, যুবমোর্চা যে লাগাতার এই বিষয় নিয়ে পথে থাকবে, সে কথা শুভেন্দু গত সোমবারই বলে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘‘নিন্দার ঝড়কে প্রতিবাদে পরিণত করতে হবে। প্রতিবাদ সবে শুরু।’’ কিন্তু ‘ঝড়’ তোলার কোনও সুযোগ কি বিজেপির সামনে আর আদৌ রয়েছে? সংশয় ভিতরে-বাইরে।