প্রেসিডেন্সির অনুষ্ঠানে উপাচার্য অনুরাধা লোহিয়া ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গত শুক্রবার। — ফাইল চিত্র।
যা হওয়ার ছিল, তা-ই হল! প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
অথচ শুরুটা কিন্তু ঠিকই হয়েছিল। সরকারি হস্তক্ষেপ হয়নি। নিয়ম মেনে বাছাই কমিটি তৈরি হয়েছিল। তাদের সুপারিশের তালিকা থেকেই আচার্যের মাধ্যমে উপাচার্য নিযুক্ত হয়েছিলেন অনুরাধা লোহিয়া। গোটা প্রক্রিয়ায় সরকারের দিক থেকে প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল না। কিন্তু সমস্যাটা শুরু হল তার পর থেকে। সরকারের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করে ফেললেন উপাচার্য। সেই ঘনিষ্ঠতা বা আনুগত্যের প্রকাশ এতটাই যে, বর্ধমানে মুখ্যমন্ত্রী যখন একশোতম প্রশাসনিক বৈঠক করতে যান, সেখানে প্রথম সারিতে হাজির প্রেসিডেন্সির উপাচার্য! এমনকী সরকারের স্তুতি করতেও দেখা গিয়েছিল তাঁকে। মুখ্যমন্ত্রীর সাম্প্রতিক লন্ডন সফরে সঙ্গী হয়েছিলেন তিনি। আনুষ্ঠানিক উদ্দেশ্য ছিল, সেখানকার দু-একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষামূলক সংযোগ গড়ে তোলা। যার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর বিমানেই গিয়েছিলেন অনুরাধা। সর্বশেষ, বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তনের আগের দিন মুখ্যমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর হাত থেকে ১০ কোটি টাকা সরকারি অনুদানের চেক নেবেন বলে। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্বশাসিত সংস্থায় মুখ্যমন্ত্রী বা শাসক দলের সঙ্গে উপাচার্যের এ হেন ঘনিষ্ঠতা নিয়ে। প্রশ্ন উঠেছে এমন এক সময়ে, যখন একের পর এক অধ্যাপক এই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। এমনকী, ২০১৩ সালে এখানে বহিরাগতদের হামলার পরেও শাসক দলের তকমাধারী অভিযুক্তদের কারও বিরুদ্ধে আজ পর্যন্ত কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
এমনই এক সামগ্রিক বাতাবরণে শুক্রবার বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে গিয়ে বিক্ষোভের মুখে পড়েন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। ছাত্র আন্দোলনের নামে শালীনতাহীন বিক্ষোভ চলে প্রেসিডেন্সির উপাচার্যকে ঘিরে। যার জেরে তাঁকে ৩০ ঘণ্টা ঘেরাও থাকতে হয়। সমাবর্তনের ঠিক আগে প্রেসিডেন্সিতে এই ছাত্র আন্দোলন যে শোভনতার সীমা ছাড়িয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। তবে উপাচার্যের শাসক দলের প্রতি অনুগত ভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতে এই আন্দোলন দেখে অনেকেই বলতে শুরু করেছেন, কলেজ স্ট্রিট আছে কলেজ স্ট্রিটেই। এখানে অন্তত পরিবর্তন হয়নি।
সে দিনের ছাত্র আন্দোলনের নিন্দা করতে গিয়ে এমনও বলা হচ্ছে যে, ক্যাম্পাসে অনেক বহিরাগত ছিল। যদি এই অভিযোগ কিছুটা সত্যও হয়, তা হলেও সেই বহিরাগতদের সংখ্যা খুব বেশি ছিল, তা বলা ঠিক হবে না। যাঁরা আন্দোলন করেছেন, তাদের কোনও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের প্রতি সহানুভূতিও থাকতে পারে। কিন্তু তাঁরা সকলে সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী, এমন তকমা দেওয়াও সঠিক হবে না। তাঁদের প্রতিবাদের পদ্ধতি কোনও ভাবেই সমর্থন করা যায় না। কিন্তু সেই প্রতিবাদের পিছনের কারণগুলো কতটা যুক্তিযুক্ত, সেই প্রশ্নটিও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। আন্দোলনকারী ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলে এটা স্পষ্ট হয় যে, তাঁদের এই ক্ষোভ এক দিনে তৈরি হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে পুঞ্জীভূত হয়েছে। যার অন্যতম হল, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বশাসনে ধাক্কা। একের পর এক ঘটনায় সরকার বা শাসক দলের প্রতি এই উপাচার্য যে ভাবে আনুগত্য প্রকাশ করে যাচ্ছেন, পড়ুয়াদের প্রতিবাদের ভাষা তাতে ইন্ধন পেয়েছে। সর্বশেষ, বিভিন্ন শিক্ষকের চলে যাওয়ার পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রীকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেকে নিয়ে আসা সেই ক্ষোভকে উস্কে দিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে উপাচার্যের এমন নেতিবাচক ভূমিকা শুধু প্রতিবাদী ছাত্রদের নয়, বহু শিক্ষাবিদকেও বিরূপ করেছে। সিলেকশন কমিটির সুপারিশ মেনে আচার্যের মাধ্যমে নিযুক্ত উপাচার্য কেন ছোটখাটো সব বিষয়ে সরকারের মুখ চেয়ে থাকবেন, সেই প্রশ্ন তাঁদের সকলেরই। আগের উপাচার্য মালবিকা সরকারের তুলনা টেনে প্রেসিডেন্সির অন্দরমহলের অনেকেরই বক্তব্য, তিনি যত দিন পদে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকার রক্ষা এবং শিক্ষাগত উৎকর্ষের উন্নয়নে সচেষ্ট থেকেছেন। পদের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করে সরকার বা শাসকদের প্রতি অকারণে আনুগত্য প্রকাশের তাড়না তাঁর ছিল না।
প্রেসিডেন্সির অন্দরের খবর, মমতাকে খুশি করতে অনুরাধাদেবীই তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ছাত্রেরা যে ক্ষোভে ফুঁসছে, সে কথা তিনি মুখ্যমন্ত্রীকে জানাননি। আর উপাচার্যের ডাকে সাড়া দিয়েই মুখ্যমন্ত্রী গত শুক্রবার প্রেসিডেন্সিতে যান। ছাত্রদের ক্ষোভ জমা হচ্ছিলই। সেটা প্রকাশের এমন সহজ সুযোগ হঠাৎ হাতে পেয়ে গিয়ে তাঁরাও কোমর বেঁধে তৈরি হন। আসলে এক দিকে সরকারি নিয়ন্ত্রণ কায়েমের চেষ্টা, আর অন্য দিকে উপাচার্যের সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের তাগিদ— এই দুয়ের মিশেলেই তৈরি হয় ক্ষোভের বীজ।
প্রেসিডেন্সি কলেজে দীর্ঘ দিন অধ্যক্ষ ছিলেন অমল মুখোপাধ্যায়। তাঁর মতে, এই সমস্যার বীজ অনুরাধাদেবীর নিয়োগের মধ্যেই রয়েছে। কারণ, উনি কোনও দিন কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ছিলেন না। বরাবর কাজ করেছেন গবেষণা সংস্থায়। ফলে ছাত্রছাত্রী-শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী নিয়ে যে একটা প্রতিষ্ঠান, তার চাওয়া-পাওয়া, তার সুষ্ঠু পরিচালনা সম্পর্কে প্রত্যক্ষ ধারণা তাঁর নেই। অমলবাবু মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাতন্ত্র্য বিসর্জন দিয়ে প্রেসিডেন্সির বর্তমান উপাচার্য তাই সরকারের মন রাখার সহজ পথই বেছে নিয়েছেন।
অমলবাবুর কথায়, ‘‘স্বশাসিত একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ কোনও সম্পর্ক থাকারই কথা নয়। এমনও নয় যে, মমতা প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনী। তা হলে উপাচার্যই বা মুখ্যমন্ত্রীকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকবেন কেন, আর মুখ্যমন্ত্রীই বা সেখানে যাবেন কেন? মঞ্চে দাঁড়িয়ে সরকারি অনুদানের চেক উপাচার্যের হাতে তুলে দেওয়াটা মুখ্যমন্ত্রীর কাজ নয়। এটি পুরোদস্তুর প্রশাসনিক কাজ, যা সবার অলক্ষে সাধারণ নিয়মেই ঘটে যাওয়ার কথা।’’
প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনী তথা আইআইএম কলকাতার শিক্ষক অনুপ সিংহ মনে করেন, একের পর এক উঁচু দরের শিক্ষক যখন প্রেসিডেন্সি ছেড়ে যাচ্ছেন, তখন বুঝতে হবে সেখানে শিক্ষার পরিবেশ নিয়ে চিন্তার কারণ রয়েছে। প্রেসিডেন্সিরই এক শিক্ষকের কথায়, ‘‘ছেড়ে যাওয়ার পিছনে হয়তো আর্থিক কারণ থাকতে পারে। কিন্তু এটাও তো ঠিক, এখানে কেমন বেতন মিলবে তা জেনেই ওই শিক্ষকেরা এসেছিলেন! তার পরেও যখন চলে যাচ্ছেন, তখন বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় নিশ্চয়ই কোনও ত্রুটি রয়েছে।’’
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অশোকনাথ বসু মনে করেন, এক দিকে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ, অন্য দিকে আনুগত্য প্রকাশের তাগিদ— এই দুয়ের পরিণামেই শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ‘টাকা দিই, তাই নিয়ন্ত্রণ থাকবে’ বলে দাবি এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজির হয়ে আন্দোলনরত ছাত্রদের সামনে ‘উপাচার্য ইস্তফা দিচ্ছেন’ বলে মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা।
বিজ্ঞানী বিকাশ সিংহ ছাত্রদের প্রতিবাদের পদ্ধতিতে ক্ষুব্ধ হলেও তাঁরও স্পষ্ট মত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারের নাক গলানো বন্ধ হওয়া দরকার। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় যাঁরা পরিচালনা করবেন, তাঁদেরও শাসকের মন জয়ের চেয়ে প্রতিষ্ঠানের স্বাধিকারকে গুরুত্ব দিতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকার খর্ব করার কাজ শুরু হয়েছিল সিপিএম জমানায়। অনিল বিশ্বাস তাকে শক্তপোক্ত করেন। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে স্বাধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ শুরু হলেও দলের মধ্যে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মতো নেতাদের পরামর্শে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই পথ থেকে সরে আসেন। ঘটনাচক্রে সেই পার্থবাবুই আজ শিক্ষামন্ত্রী।
প্রবীণ শিক্ষাবিদরা অনেকেই মনে করছেন, প্রেসিডেন্সির গত দু’দিনের ছাত্র আন্দোলন যতই নিন্দনীয় হোক, তার মূল কারণকে এড়িয়ে গেলে বা ঘুরিয়ে দিলে শুধু এই প্রতিষ্ঠানের পক্ষেই নয়, সামগ্রিক ভাবে শিক্ষা জগতের পক্ষেও এক ভয়াবহ ইঙ্গিত বহন করবে।