ফাঁকা জমিতে কাটমানি দিত হয় প্রতি বর্গফুটেই

আটঘরার এক বাসিন্দার অভিযোগ, তিনি কাউন্সিলরের প্রতিনিধিকে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন, বাড়ির সামনের ফাঁকা জমিটা তাঁর মায়ের। সেটি এখনই প্রোমোটারের হাতে তুলে দিতে চান না তিনি। বরং সেখানে লোহার শেড দিয়ে গ্যারাজ বানিয়ে তা ভাড়া দিতে চান।

Advertisement

আর্যভট্ট খান

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০১৯ ০২:৩৭
Share:

আটঘরার এই জমির জন্য কাটমানি চাওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ। নিজস্ব চিত্র

ফাঁকা জমির প্রতি বর্গফুটে ‘কাটমানি’। আর সেই কাটমানির ভাগিদার অনেক। সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কাটমানি সম্পর্কে অভিযোগ জানাতে যে টোল-ফ্রি নম্বর চালু করার কথা বলেছেন, তা শুনে রাজারহাটের বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, ফোন করে অভিযোগ জানাতে হলে তো ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে।

Advertisement

রাজারহাটের বাসিন্দাদের অভিযোগ, সেখানে বহু ক্ষেত্রেই নিজের জমিতে নিজের ইচ্ছে মতো কিছু করার অধিকার থাকে না। যেমন, বিধাননগর পুরসভার ১২ নম্বর ওয়ার্ডের আটঘরার এক বাসিন্দার অভিযোগ, তিনি কাউন্সিলরের প্রতিনিধিকে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন, বাড়ির সামনের ফাঁকা জমিটা তাঁর মায়ের। সেটি এখনই প্রোমোটারের হাতে তুলে দিতে চান না তিনি। বরং সেখানে লোহার শেড দিয়ে গ্যারাজ বানিয়ে তা ভাড়া দিতে চান।

অভিযোগ, এর পরেই তাঁর উপরে পুরসভার কয়েক জন প্রতিনিধির চাপ আসতে থাকে। বলা হয়, এত ভাল জায়গায় প্রোমোটারকে জমি দিয়ে দিলেই সব থেকে বেশি লাভ। ওই যুবক বলেন, “আমি অনড় দেখে পুর প্রতিনিধিরা এসে ওই জমিতে ব্যবসা করার নানা রকম আইনি জটিলতা দেখিয়ে আমাকে ভয় দেখাতে শুরু করলেন। এর পরে বলা হল, ব্যবসা করতে হলে ওঁদের সঙ্গে টাকার ‘সেটিং’ করতে হবে।”

Advertisement

এখনও পর্যন্ত ‘সেটিং’ করেননি আটঘরার ওই বাসিন্দা। তাই জমির উপরে লোহার শেড লাগানোর পরে তাঁর কাজও থমকে আছে। ওই বাসিন্দা বলেন, “আমি যে জায়গায় থাকি, সেখানে এক কাঠা জমির দাম ২০ লক্ষ টাকা। কাঠা-পিছু পাঁচ শতাংশ মানে এক লাখ টাকা করে কাটমানি দিতে হবে। এত টাকা কেন দেব?”

কাঠা-পিছু পাঁচ শতাংশ। এটাই এখানে কাটমানির রেট। ওই যুবক জানান, তাঁর সঙ্গে কাটমানি নিয়ে দরাদরি করতে শেষ পর্যন্ত পুর প্রতিনিধিরা বাড়িতে হানা দিতে শুরু করেন। বাড়িতে কারা কারা ঢুকছেন, তা ক্যামেরাবন্দি করতে দরজার সামনে সিসি ক্যামেরা লাগান ওই যুবক। তিনি বলেন, “এত দিন অভিযোগ জানাতে সাহস হয়নি। এ বার মুখ্যমন্ত্রীর দেওয়া টোল-ফ্রি নম্বরে ছবি-সহ প্রমাণ দিয়ে অভিযোগ জানাব।” ওই জমিতে ব্যবসার কাজ শুরু করা এখন বিশ বাঁও জলে।

এক প্রাক্তন কাউন্সিলরের মতে, কয়েক বছরে রাজারহাট এলাকায় বাসিন্দার সংখ্যা যে হারে বেড়েছে, সেই চাহিদা অনুযায়ী জমি এখন কম। ২০১৫ সালে রাজারহাট পুরসভা বিধাননগরে মিশে যাওয়ার পর থেকে নতুন করে কোনও জমির নকশা অনুমোদনও হয়নি। ফলে যে সব জমির নকশা ২০১৫ সালের আগে অনুমোদন পেয়েছে, একমাত্র সেখানেই বহুতল তৈরি হতে পারে। তাই নকশা অনুমোদন হওয়া ফাঁকা জমিতে বহুতল গড়ার পরিকল্পনা করলেই সেখানে ‘পুর দাদারা’ আনাগোনা শুরু করেন বলে অভিযোগ। কাটমানির অনেক ভাগিদার হওয়ায় গোষ্ঠীদ্বন্দ্বও রাজারহাটে নতুন নয়।

অনুমোদন না পাওয়া জমিতেও শুরু হয়ে যেতে পারে বহুতল। এমনকি, সাত ফুট বা দশ ফুট চওড়া রাস্তার ধারেও হতে পারে বহুতল। বেআইনি হলেও তার জন্য রয়েছে আলাদা ‘সেটিং’। এই ধরনের জমিতে প্রতি কাঠার যা দাম, তার দশ শতাংশ কাটমানি দিতে হয়। বাগুইআটির এক প্রোমোটারের স্বীকারোক্তি, আট ফুট রাস্তার ধারে তিন কাঠা ফাঁকা জমি তিনি পেয়েছিলেন। জমির মালিকের সঙ্গে রফা করে বহুতল তোলার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু কাটমানির রেট শুনে পিছিয়ে আসেন।

একই চিত্র উত্তর ও দক্ষিণ কলকাতার পুরনো জমির হাতবদলের ক্ষেত্রেও। সেখান থেকে নেওয়া কাটমানির বখরা উঁচুতলার নেতারাও পান বলে দাবি করছেন নেতাদেরই কেউ কেউ।

এ নিয়ে অভিযোগ প্রায় হয় না বললেই চলে। ভুক্তভোগীদের প্রশ্ন, জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করব? বিধাননগরের পুলিশ কমিশনার লক্ষ্মীনারায়ণ মিনা অবশ্য বলছেন, “যে কেউ নির্ভয়ে অভিযোগ জানাতে পারেন। অভিযোগ এলে তৎপরতার সঙ্গে খতিয়ে দেখি।” বিধাননগর পুরসভার ডেপুটি মেয়র তাপস চট্টোপাধ্যায় বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠবে, তাঁদের নাম জানাতে। কারও অভিযোগ থাকলে নির্ভয়ে জানান। সরাসরি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও জানাতে পারেন। পুরসভার কোনও প্রতিনিধি যদি কাটমানি খেয়ে থাকেন, তাঁর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেব।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন