অপুষ্টিতে ভোগা শিশু কোলে টিকার লাইনে কিশোরী মা

বেহালার ট্রাম ডিপো সংলগ্ন এলাকায় একাধিক পথশিশুর টিকাকরণ কর্মসূচির বাইরে থাকার বিষয়টি সামনে আসে সম্প্রতি। বিষয়টি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পরে ওই পথশিশুদের খোঁজে নামে পুরসভার স্বাস্থ্য বিভাগের একটি প্রতিনিধি দল।

Advertisement

সৌরভ দত্ত

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০১৯ ০২:৩১
Share:

স্নেহ: মেয়ে অয়ন্তিকার সঙ্গে পূজা। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

শিশুকন্যার বয়স এক বছর দু’মাস। কিন্তু কোনও রকম টিকাকরণই হয়নি তার। আর ওই শিশুকন্যার ১৫ বছর বয়সী মা ভুগছে রক্তাল্পতায়। মাত্র সাড়ে ১২ বছর বয়সে বিয়ে হওয়া ফুটপাতবাসী ওই কিশোরী সন্তানের সঙ্গে নিজেও টিকা নেবে আগামী বুধবার। কোনও প্রত্যন্ত গ্রাম নয়, এই ঘটনা খাস কলকাতার।

Advertisement

বেহালার ট্রাম ডিপো সংলগ্ন এলাকায় একাধিক পথশিশুর টিকাকরণ কর্মসূচির বাইরে থাকার বিষয়টি সামনে আসে সম্প্রতি। বিষয়টি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পরে ওই পথশিশুদের খোঁজে নামে পুরসভার স্বাস্থ্য বিভাগের একটি প্রতিনিধি দল। বেহালা ট্রাম ডিপোর উল্টো দিকে, একটি মন্দিরের সামনে খোঁজ মেলে ওই শিশুদের। বুধবার ওই শিশু এবং তাদের মায়েদের ১২০ নম্বর ওয়ার্ডের কোকলাবাগান স্বাস্থ্যকেন্দ্রে (ইউপিএইচসি) আনা হয়। সরকারি কর্মসূচি অনুযায়ী, প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিসিজি (যক্ষ্মার টিকা), ওপিভি (ওরাল পোলিয়ো ভ্যাকসিন) এবং হেপাটাইটিস বি-এর টিকা দেওয়ার মাধ্যমে সদ্যোজাতের টিকাকরণ শুরু হয়। ১৬ বছর বয়সে টিটেনাস টক্সয়েড বুস্টার ডোজের পরে সেই টিকাকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।

কলকাতা পুরসভা সূত্রের খবর, বুধবার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আগত ফুটপাতবাসীদের মধ্যেই ছিল পূজা দাস। সাড়ে ১২ বছর বয়সে বিয়ে হওয়ার পরে এক বছরের মাথায় গর্ভবতী হয় সে। তার মেয়ে অয়ন্তিকা দাসের এক বছর দু’মাস বয়স হলেও ওজন মাত্র সাড়ে পাঁচ কিলোগ্রাম। চরম অপুষ্টির শিকার অয়ন্তিকার জ্বর থাকায় এ দিন টিকাকরণ শুরু করা যায়নি। শুধু ওপিভি এবং ভিটামিন এ দেওয়া হয়েছে। আগামী বুধবার অয়ন্তিকাকে ডিপিটি বুস্টার (ডিপথেরিয়া ও টিটেনাসের টিকা) এবং এমআর (হাম, রুবেলা) টিকা দেওয়া হবে। ওই দিন সন্তানের সঙ্গে নিজেও ১৬ বছরের টিকা টিটেনাস বুস্টার ডোজ নেবে বলে চিকিৎসকদের কথা দিয়েছে পূজা।

Advertisement

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

আদতে ফলতার মল্লিকপুরের বাসিন্দা ওই কিশোরীর কথায়, ‘‘বিয়ে আমার মর্জিতে হয়নি। গ্রামে খুব অভাব ছিল বলে মা শহরে কাজ করতে চলে আসে। ফুটপাতেই থাকতাম। এক দিন যখন ঘুমোচ্ছি, তখন ষড়যন্ত্র করে আমার পাশে ছেলেটাকে শুইয়ে দেওয়া হয়। সবাই মিলে বলল, বিয়ে না করলে মারবে। আমি নাকি নোংরামি করছি। বাধ্য হয়ে রাজি হলাম।’’ পুরসভা সূত্রের খবর, গর্ভবতী হওয়ার পরে প্রসবের সময়েই প্রথম হাসপাতালে গিয়েছিল পূজা। গর্ভবতী অবস্থায় যে টিটেনাস, আয়রন ট্যাবলেট, ফলিক অ্যাসিড, ক্যালসিয়াম দেওয়া হয়, সে সব কিছুই জোটেনি পূজার।

জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের নির্দেশিকা অনুযায়ী পথশিশুদের স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিতে রয়েছে বিশেষ প্রকল্প। গর্ভবতী মায়েদের কী করা করণীয় এবং প্রসবের পরে তাঁরা নিজেদের যত্ন নিচ্ছেন কি না, তা নিয়ে সচেতনতা কর্মসূচির কথাও বলা হয়েছে নির্দেশিকায়। কিন্তু এই সব সুবিধার কিছুই পৌঁছয়নি ফুটপাতবাসী ওই শিশু ও মায়েদের কাছে। সংবাদমাধ্যমকে পূজারা জানিয়েছিলেন, কোথায় টিকা দেওয়া হয়, তা জানেন না তাঁরা। বুকের সংক্রমণে মৃত্যু হওয়া শিশু সৌরভের মা মৌসুমী ভট্টাচার্য জানিয়েছিলেন, টিকাকরণের কোনও কার্ড পাননি তিনি। একই বক্তব্য ছিল তিন সন্তানের মা বৃহস্পতি হালদারের। পুরসভা সূত্রের খবর, বৃহস্পতির সাত মাসের সন্তান জিৎ হালদারেরও অপুষ্টি ধরা পড়েছে। তিন সন্তানের মধ্যে সে-ই ছোট। মেজো বিশ্বজিৎ এবং বড় মেয়ে কাজল ছ’মাস পর্যন্ত টিকা পেয়েছিল। কিন্তু শহরে আসার পরে তাদেরও টিকাকরণ হয়নি। আরও যে চার শিশুকে এ দিন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আনা হয়েছিল, তাদেরও সকলের কমবেশি অপুষ্টি রয়েছে। স্থানীয় অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র থেকে বৃহস্পতিরা যাতে একবেলার খাবার পান, তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি

বয়স অনুযায়ী শিশুদের টিকা দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে বলে পুরসভা সূত্রের খবর।

পুরসভার স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মীদের একাংশ জানান, পূজাদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসার কথা কেউ যে বলেননি তা নয়। তবে টিকাকরণ নিয়ে বিভ্রান্তি থাকায় তাঁদের আবেদনে সাড়া মেলেনি। কিন্তু জাতীয় স্বাস্থ্য মিশন প্রকল্পের নির্দেশিকা অনুযায়ী এই বিভ্রান্তি তো স্বাস্থ্যকর্মীদেরই কাটানোর কথা?

পুরসভার স্বাস্থ্য বিভাগের এক পদস্থ কর্তা বলেন, ‘‘ফুটপাতবাসী মায়েদের মধ্যে বিভ্রান্তি কাটিয়ে তাঁদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আনার জন্য যত সংখ্যক স্বাস্থ্যকর্মী প্রয়োজন, তা আমাদের নেই। অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীর সংখ্যাও কমে গিয়েছে। তবুও সমস্যা কাটিয়ে এই সকল মা ও শিশুদের কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা করছি।’’ জাতীয় স্বাস্থ্য মিশন প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত স্বাস্থ্য ভবনের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘গ্রামের মতো শহরে আশাকর্মী নেই। পরিবর্তে অনারারি হেলথ ওয়ার্কারদের (এইচএইচডব্লিউ) নিয়োগ করার কথা কলকাতা পুরসভার। তবে পুরসভার এএনএম (অক্সিলিয়ারি নার্স মিডওয়াইফ) নেই, সেটাও একটা সমস্যা। প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাস্থ্যকর্মী তৈরি করাও তো সময়সাপেক্ষ বিষয়।’’

স্বাস্থ্য পরিষেবার সেই ফাঁক গলে তাই ব্রাত্যই থেকে যান পূজা দাসেরা। শহরের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সন্তান কোলে ওই কিশোরী মায়েদের নিজেদেরই টিকা নিতে হয়!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন