পুজো মিটলেই বিসর্জনের বাদ্য-যন্ত্রণা, শঙ্কায় শহর

রাস্তা দিয়ে চলেছে বিসর্জনের শোভাযাত্রা। কিন্তু ঢাক বা কুড়কুড়ির বোল নেই। বদলে তারস্বরে দাপাচ্ছে যান্ত্রিক শব্দদৈত্য! সেই ‘দৈত্যের’ দাপাদাপিতে ত্রস্ত চারপাশের মানুষজন। রাস্তার কুকুর-বেড়ালেরাও আতঙ্কে পাড়াছাড়া!

Advertisement

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০১৬ ০০:৪৩
Share:

রাস্তা দিয়ে চলেছে বিসর্জনের শোভাযাত্রা। কিন্তু ঢাক বা কুড়কুড়ির বোল নেই। বদলে তারস্বরে দাপাচ্ছে যান্ত্রিক শব্দদৈত্য! সেই ‘দৈত্যের’ দাপাদাপিতে ত্রস্ত চারপাশের মানুষজন। রাস্তার কুকুর-বেড়ালেরাও আতঙ্কে পাড়াছাড়া!

Advertisement

বিমানবন্দরের ১ নম্বর গেটের কাছে ধর্মীয় শোভাযাত্রা যাচ্ছে। সেই ভিড়ে রাস্তাঘাটে সব গাড়িঘোড়া থমকে গিয়েছে। আটকে পড়া যাত্রীদের অবস্থা শোচনীয়। তার উপরে শোভাযাত্রার প্রতিটি গাড়িতেই তারস্বরে বাজছে ডি জে। কার্যত বন্দি অবস্থায় সেই শব্দদৈত্যের দাপটে অনেকে অসুস্থ বোধ করতেও শুরু করেন। কিন্তু রেহাই পাওয়ার উপায় ছিল না। আশপাশে দাঁড়ানো পুলিশকর্মীরাও কার্যত নীরব দর্শকের ভূমিকায় ছিলেন।

গত কয়েক বছরে কলকাতা ও শহরতলিতে ক্রমশই পরিচিত হয়ে উঠেছে শব্দদৈত্যের উপদ্রব। চলতি ভাষায় যে দৈত্যের নাম ‘ডি জে’। আদতে একটি সিডি প্লেয়ার। সঙ্গে অ্যামপ্লিফায়ার লাগানো পেল্লায় সাউন্ডবক্স। তাতেই চটুল গান বাজিয়ে চলে শোভাযাত্রা। কালীপুজোর আগে চকলেট বোমা, দোদমা-সহ শব্দবাজির পাশাপাশি এই নয়া উপদ্রব নিয়েও মানুষ আতঙ্কে।

Advertisement

আইন বলছে, রাস্তা কিংবা প্রকাশ্য এলাকায় ‘ডি জে’ বাজানো নিষিদ্ধ। কিন্তু আমজনতার অভিজ্ঞতা বলছে, আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিনের পর দিন বাড়ছে ডি় জে-র রমরমা। শুধু কালীপুজো, দুর্গাপুজো নয়, পাড়ার ছোটখাটো পুজো, অনুষ্ঠান, জলসাতেও এখন ডি জে-র ব্যবহার চরমে। সকলের চোখের সামনে নিষিদ্ধ এই যন্ত্রের ব্যবহার কী ভাবে চলছে, তা নিয়েও কোনও সদুত্তর মেলে না।

চিকিৎসকেরা বলছেন, শব্দবাজি নিয়ে নানা সময়ে নানা আপত্তি করা হয়। কিন্তু ডি জে-র ক্ষতিকারক দিকও কম নয়। ইএনটি বিশেষজ্ঞ দীপঙ্কর দত্ত বলছেন, শব্দদূষণের জেরে এমনিতেই বধিরতা আসতে পারে। কিন্তু ডি জে বক্সের ক্ষেত্রে আরও একটি বিপদ হল নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কের শব্দে বধিরতা। ডিজে বক্স থেকে কম কম্পাঙ্কের একটি শব্দমাত্রা বেরোতে থাকে। কানের সামনে ওই শব্দ বেশি ক্ষণ বাজলে তা সরাসরি মানুষের কম কম্পাঙ্কের শব্দ শোনার স্নায়ুগুলির ক্ষতি করে। দীপঙ্করবাবুর অভিজ্ঞতা, ‘‘অনেক সময়েই এমন কিছু রোগী আসেন, যাঁরা কিছু ধরনের শব্দ শুনতে পাচ্ছেন এবং কিছু ধরনের শব্দ শুনতে পাচ্ছেন না। এর পিছনে অনেক সময়েই ডি জে-র শব্দ দায়ী।’’

চিকিৎসকেরা এ-ও বলছেন, কানের ক্ষতি করা ছাড়াও শব্দদৈত্যের দাপটে বুক ধড়ফড়, শরীরে অস্থির ভাব, স্ট্রেস বাড়তে পারে। নবজাতক বা সদ্যোজাতদের মনে এই শব্দ আতঙ্ক তৈরি করে। পশুপাখিরাও এই শব্দের দাপটে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।

আমজনতার প্রশ্ন, এই উপদ্রব থেকে রেহাই পাওয়ার কোনও উপায় কি নেই? পরিবেশকর্মী ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের কর্তাদের একাংশের মতে, ডি জে প্রেক্ষাগৃহ কিংবা নাইটক্লাবের ভিতরে বাজানো আইনসিদ্ধ। ফলে শব্দবাজির মতো এর উৎপাদন ঠেকানো বা ব্যবসা বন্ধ করা সম্ভব নয়। রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের প্রাক্তন মুখ্য আইন অফিসার বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় বলেন, এই উপদ্রব ঠেকানোর একটাই উপায়, কড়া আইনি দাওয়াই। তাঁর মতে, ডি জে বাজতে দেখলেই সঙ্গে সঙ্গে বাজেয়াপ্ত করা উচিত। কারণ, এ ভাবে বাজেয়াপ্ত করা হলে ডি জে ভাড়া দেওয়ার ব্যবসা ঠেকানো সম্ভব। ‘‘এর আগে মাইক ধরপাকড়ে এই দাওয়াই প্রয়োগ করে ফল মিলেছিল’’, বলছেন বিশ্বজিৎবাবু। তিনি বলছেন, শব্দ আইন অনুযায়ী রাত দশটার পরে যে কোনও শব্দকেই বন্ধ করার এক্তিয়ার পুলিশ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের রয়েছে। সে ক্ষেত্রে ওই শব্দ কারও সমস্যা তৈরি করছে কি না, তা বিচার করে দেখতে হবে।

তা হলে কি এ বার কালীপুজোয় ডি জে তাণ্ডব বন্ধ হবে?

রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্র বলছেন, ‘‘ডি জে পুরোপুরি নিষিদ্ধ। যেখানেই ডি জে বাজবে, পুলিশ ও পর্ষদ ব্যবস্থা নেবে।’’ পর্ষদ জানিয়েছে, ডি জে-র তাণ্ডব দেখলেই ‘১০০’ বা পর্ষদের কন্ট্রোল রুম ‘২৩৩৫-৮২১২/৩৯১৩’-এ খবর দিন। সম্প্রতি কালীপুজোয় দূষণ ঠেকানোর বৈঠকেও পুলিশের সঙ্গে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে পর্ষদকর্তাদের। একই কথা বলছে কলকাতা পুলিশও। যুগ্ম কমিশনার (সদর) সুপ্রতিম সরকার বলেন, ‘‘ডি জে যে নিষিদ্ধ, তা কালীপুজোর সমন্বয় বৈঠকে ক্লাবগুলিকে জানানো হয়েছে। পরে থানা মারফতও একই বার্তা পুজো কমিটিগুলিকে জানানো হয়েছে।’’ পুলিশকর্তাদের দাবি, ডিজে বাজাতে দেখলে এ বার যন্ত্রপাতি বাজেয়াপ্ত করা হবে এবং প্রয়োজনে গ্রেফতারও করা হতে পারে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন