Ram Mohan Roy

Ram Mohan Roy: রামমোহনের ২৫০তম জন্মবার্ষিকীতে ইতিহাস বাঁচাতে সাহায্যের ডাক

এই লাইব্রেরির সংস্কার কমিটির অন্যতম সদস্য তথা ক্যানসার  চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় বললেন, ‘‘আমাদের মতো আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে ফ্রি রিডিং লাইব্রেরির প্রয়োজনীয়তা হয়তো প্রশাসনিক কর্তারা উপলব্ধিই করতে পারছেন না। নিরুপায় হয়েই তাই সাধারণ মানুষের কাছে আবেদন জানাচ্ছি। রামমোহনের ২৫০তম জন্মবার্ষিকীতে আশা করি এই গ্রন্থাগারের শাপমোচন হবে।’’

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০২২ ০৭:৩৩
Share:

অবহেলা: (বাঁ দিকে) রামমোহন লাইব্রেরিতে জীর্ণ ছাদের তলায় পড়ে অমূল্য বইয়ের সংগ্রহ। (ডান দিকে) রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখার পাণ্ডুলিপিও। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

দিনটা ১৯১৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। মাস দুয়েক আগেই নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ওই দিনই কলকাতায় আপার সার্কুলার রোডে (বর্তমানে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোড) রামমোহন লাইব্রেরির প্রেক্ষাগৃহে কবির প্রথম সংবর্ধনা। উপস্থিত সকলেই গীতাঞ্জলি থেকে কিছু একটা শোনানোর জন্য ধরেছেন কবিকে। বিনা বাক্যব্যয়ে কবিও জানিয়ে দিয়েছেন, ওই বইয়ের লেখা তাঁর তেমন মনে নেই। ফলে শোনানো সম্ভব নয়। কিন্তু উপস্থিত সকলেই নাছোড়। কবির অনুমতি নিয়ে অবশেষে বই নামানো হল দোতলার লাইব্রেরি থেকে। গীতাঞ্জলি হাতে নিয়ে ‘রাত্রি যখন আঁধার হলো’ পাঠ করে শোনালেন রবীন্দ্রনাথ।

Advertisement

সে দিনের সেই গল্প বলতে বলতে উত্তেজনায় গলা কাঁপছিল রামমোহন লাইব্রেরি অ্যান্ড ফ্রি রিডিং রুমের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক, সত্তরোর্ধ্ব শঙ্কর ভট্টাচার্যের। বললেন, ‘‘এই ইতিহাস ধরে রাখাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যেই সিলিংয়ের চুন-সুরকি খসে পড়ছে। বৃষ্টি হলেই ছাদ থেকে জল পড়ে। প্রেক্ষাগৃহের আসন ভেঙে গিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ যে বই হাতে নিয়ে পাঠ করেছিলেন, সেটাই বা কত দিন বাঁচিয়ে রাখতে পারব জানি না।’’

শঙ্করবাবু আরও বলছেন, ‘‘শুধু কি রবীন্দ্রনাথ! রাজা রামমোহন রায়ের সঙ্গে জড়িত একাধিক ঐতিহাসিক সামগ্রী রয়েছে এখানে। সেগুলিরই বা কী হবে? ২২ মে রামমোহন রায়ের ২৫০তম জন্মবার্ষিকী। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েও কোনও পথ খুঁজে পাচ্ছি না।’’

Advertisement

শুধু পরিচালন সমিতিই নয়, শহরের প্রাণকেন্দ্রের এই ঐতিহাসিক ভবন একই রকম চিন্তায় রেখেছে বিশিষ্টজনদের অনেককেই। কঠিন পরিস্থিতিতে প্রায় কোথাও থেকেই সাহায্য না পেয়ে তাই এখন ভবন, প্রেক্ষাগৃহ এবং গ্রন্থাগার সংস্কারে সাধারণ মানুষের কাছে অর্থসাহায্যের আবেদন রেখেছেন তাঁরা। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী, তিলোত্তমা মজুমদারদের মতো সাহিত্যিক, অভিজিৎ রায়, প্রণবেশ চক্রবর্তীর মতো শিক্ষাবিদ, চন্দন সেন, কল্যাণ সেন বরাট, কৌশিক সেন, বাদশা মৈত্রের মতো শিল্পীরাও রয়েছেন এই বিদ্বজ্জনদের তালিকায়। রয়েছেন প্রাক্তন বিচারপতি চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায়, আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যও। এই উদ্যোগের কারণ হিসাবে তাঁরা জানাচ্ছেন, এক সময়ে এই গ্রন্থাগারের সদস্য ছিলেন বাংলা নবজাগরণের পুরোধারা। রবীন্দ্রনাথ এই গ্রন্থাগারের সহ-সভাপতি ছিলেন ১৯১১ থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত। এখানেই তিনি যোগ দিয়েছিলেন অন্তত ২২টি বৈঠকে। ১৯১৩ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত গ্রন্থাগারের সভাপতি পদে ছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু। ভগিনী নিবেদিতা সহ-সভাপতির দায়িত্ব সামলেছেন ১৯০৫-১৯১১ সাল পর্যন্ত। দীর্ঘ দিন সহ-সভাপতি ছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ও। এখানেই রয়েছে রামমোহনের ব্যবহৃত একাধিক সামগ্রী, দুষ্প্রাপ্য বই, নীল চাষ মামলার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ নথি, এশিয়াটিক সোসাইটির কাগজপত্র, ভগিনী নিবেদিতার লেখার দলিল।

কিন্তু এক কালের সাহিত্য এবং আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রাণকেন্দ্র এই লাইব্রেরির এমন দশা হল কী করে? গ্রন্থাগারের সঙ্গে যুক্তেরা জানাচ্ছেন, ১৯০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই লাইব্রেরি ১৯১১ সালে তদানীন্তন ক্যালকাটা কর্পোরেশন (অধুনা কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন)-এর কাছে আবেদনের ভিত্তিতে অনুদান হিসেবে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোডে ছ’কাঠা জমি পেয়েছিল। সেখানেই পরে তৈরি হয় লাইব্রেরি ভবন এবং প্রেক্ষাগৃহ। এখনও সেই ঠিকানাতেই রয়েছে গ্রন্থাগার। ব্রিটিশ সরকার এই ভবনের জন্য কর নিত না। স্বাধীনতার পরে প্রথমে কর চাপানো হলেও পরে তা মকুব করা হয়। সেই সঙ্গে গ্রন্থাগারের খরচ চালাতে দেওয়া হত বছরে দু’লক্ষ টাকা। কিন্তু চারতলা ভবনের সংস্কার, কর্মীদের বেতন থেকে শুরু করে নতুন বই কিনে লাইব্রেরি চালানো— সব কিছু ওই টাকাতেই করা ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়তে শুরু করে বলে জানাচ্ছেন তাঁরা। অভিযোগ, করোনা-কালে সেই টাকাও আসেনি গত দু-তিন বছর। সেই সঙ্গে সরকারের দেওয়া এক গ্রুপ-ডি কর্মী ২০০৪ সালে অবসর নেওয়ার পরে ২০০৯ সালে এক জনকে সেই চাকরিতে বহাল করা হলেও ২০১৪ সালের পর থেকে নতুন কোনও গ্রন্থাগারিক নিয়োগ করা হয়নি। শঙ্করবাবু বলছেন, ‘‘আমাদের মতো বয়স্ক, বহু দিন ধরে যাঁরা এই লাইব্রেরির সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের দিয়েই কাজ চালানো হচ্ছে। কেন্দ্রের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিলাম, কিন্তু লাভ হয়নি। সংস্কারের জন্য কত টাকা প্রয়োজন, তার বাজেট করে জমা দিতে বলা হলেও এত বছরে সেই ফাইল একটুও এগোয়নি।’’

এই লাইব্রেরির সংস্কার কমিটির অন্যতম সদস্য তথা ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় বললেন, ‘‘আমাদের মতো আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে ফ্রি রিডিং লাইব্রেরির প্রয়োজনীয়তা হয়তো প্রশাসনিক কর্তারা উপলব্ধিই করতে পারছেন না। নিরুপায় হয়েই তাই সাধারণ মানুষের কাছে আবেদন জানাচ্ছি। রামমোহনের ২৫০তম জন্মবার্ষিকীতে আশা করি এই গ্রন্থাগারের শাপমোচন হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন