Ghost fear in West Bengal Assembly

বিধানসভা ভবনে ‘তেনারা’? রাত হলেই নাকি খুটখাট শব্দ! ভোটার তালিকা ছেড়ে ‘ভূত’ সটান বিধানসভায়?

বিধানসভা ভবনের এমন ‘সুনাম’ তো আগে ছিল না! হঠাৎ কী হল! তবে কি ভোটের আগে ভোটার তালিকা ছেড়ে ভূত এ বার বিধানসভার অন্দরেও ঢুকে পড়ল? না আসলেই ‘সব ঝুট হ্যায়’?

Advertisement

অমিত রায়

শেষ আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০২৫ ১০:৩৩
Share:

খাস কলকাতায় বিধানসভা ভবনে নাকি ভূতের উৎপাত শুরু হয়েছে! গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

‘তেনারা’ কি সত্যিই আছেন? না ‘সব ঝুট হ্যায়’?

Advertisement

শীতের শিরশিরানি শুরু হওয়ার আগে সেই প্রশ্ন আরও এক বার উঁকি দিল কলকাতায়। বস্তুত, খোদ বিধানসভা ভবনে! শহরের মধ্যভাগে ব্রিটিশ আমলে তৈরি প্রাচীন বিধানসভা ভবনে নাকি ‘ভূতের উপদ্রব’ শুরু হয়েছে! রাত হলেই দোতলার বিশেষ একটি কক্ষের বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে ‘অশরীরী’! নিরাপত্তারক্ষীদের একাংশ ভয়ে কাঁটা। দাবি, পুজো-দীপাবলি মিলিয়ে দীর্ঘ ছুটিতে বিধানসভা বন্ধ থাকার পর কিছু বিষয় নাকি ‘বদলে’ গিয়েছে। রাতে নাকি নানারকম শব্দও শোনা যাচ্ছে!

তবে এ সবই এখনও ‘শোনা’। ‘দেখা’ নয়। বিধানসভা ভবনের নিরাপত্তার দায়িত্বপ্রাপ্তদের একাংশ এই ‘ভূত-তত্ত্ব’ যথারীতি হেসে উড়িয়ে দিচ্ছেন। তাঁদের বক্তব্য, বিধানসভায় রাতে কেউ থাকে না। বেশির ভাগ আলো নেবানো থাকে। ফলে রাতের দিকে ইঁদুর, ছুঁচো, ভামবিড়ালের আনাগোনা বেড়ে যায়। তাদের ‘ফ্রিস্টাইল’ চলাফেরায় নানা রকম শব্দ হওয়াই স্বাভাবিক। দুর্গাপুজো উপলক্ষে সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে বিধানসভা টানা বন্ধ। মাঝে এক সপ্তাহ কাজকর্ম হওয়ার পরে আবার কালীপুজো, ভাইফোঁটা, ছটপুজো উপলক্ষে দিন দশেকের ছুটি। এই সময়টায় দিনের আলোতেও বিধানসভা ভবন ‘নির্জন’। স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘আসলে এত বড় জায়গা, এত বড় বাড়ি। তাই দু’-একজন লোক থাকলে তাদের ভয় হবেই। একটা মানসিক চাপ তো থাকে। সেটা ভূতের চাপ কি না বলতে পারব না।’’

Advertisement

কলকাতার পুরনো বাড়িগুলিতে ভূত-তত্ত্ব নতুন নয়। টাউন হল থেকে শুরু করে জাতীয় গ্রন্থাগার, আলিপুরের হেস্টিংস হাউস বা মহাকরণ ভূতুড়ে ভবনের সমাজে ‘কুলীন’। কিন্তু বিধানসভা ভবনের এমন ‘সুনাম’ আগে ছিল না!

বিধানসভা ভবনের ভিতরে রাতে কেউ থাকেন না। বাইরে প্রহরায় থাকেন নিরাপত্তারক্ষীরা। কখনও-সখনও বিশেষ প্রয়োজনে তাঁরা রাতে অন্দরে প্রবেশ করেন। সেখানেই ঘটেছে বিপত্তি! নিরাপত্তারক্ষীদের একাংশের দাবি, চলতি মাসে রাতের দিকে পাহারাদারদের কেউ কেউ বিধানসভা ভবনের ভিতর ‘অশরীরী উপস্থিতি’ টের পেয়েছেন। দোতলার বিজয় বন্দ্যোপাধ্যায় কক্ষের সামনে নাকি বিশেষ ভাবে এই উপস্থিতি লক্ষ (থুড়ি, অনুভব) করা যাচ্ছে! নিরাপত্তারক্ষীদের একাংশের বক্তব্য, এ মাসে রাতের দিকে এমন অনেক শব্দ শোনা যাচ্ছে, যা নাকি আগে কখনও শোনা যায়নি। কেউ কেউ নাকি ‘অশরীরী পদধ্বনিও’ শুনতে পেয়েছেন!

রসিকজনেরা বলছেন, বিধানসভা নির্বাচন আসছে। ‘ভূত’ কি এবার ভোটার তালিকা ছেড়ে একেবারে বিধানসভা ভবনেই ঢুকে পড়ল?

মালদহের রতুয়ার পাঁচ বারের বিধায়ক সমর মুখোপাধ্যায় ১৯৮২ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় যাতায়াত করছেন। তাঁর মনে হচ্ছে, ভূত নিয়ে এই বাড়াবাড়ির পিছনে ‘মানসিক অসুস্থতা’ থাকতে পারে। প্রবীণ বিধায়কের কথায়, ‘‘আমি বহু বছর ধরে বিধানসভায় যাতায়াত করছি। কিন্তু কখনও সেখানে ভূতের দেখা মিলেছে বলে শুনিনি। ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি, সবটাই কাল্পনিক। মানসিক অসুস্থতা থেকেও অনেক সময় মানুষ এমন ভুলভাল ভাবে।’’

তবে পশ্চিমবঙ্গে ভূতে বিশ্বাসী রাজনীতিবিদের অভাব নেই। প্রয়াত সুব্রত মুখোপাধ্যায় মনেপ্রাণে মানতেন, ভূতের অস্তিত্ব আছে। সত্তরের দশকে তিনি রাজ্যের মন্ত্রী থাকাকালীন যে তিনি মহাকরণে ভূত দেখেছেন, তা বাখান করেই বলতেন সুব্রত। বহু সময় তিনি বলেছেন, জরুরি অবস্থার সময় রাজ্যের তথ্যমন্ত্রী থাকাকালীন বিভিন্ন খবরের কাগজে প্রকাশিতব্য রিপোর্ট তাঁর পর্যবেক্ষণের জন্য পাঠানো হত। সেই কারণে মহাকরণে তাঁকে অনেক রাত পর্যন্ত থাকতে হত। কাজ শেষ করে বেরোনোর সময় প্রাচীন বাড়ির লিফ্‌টের সামনে তিনি একাধিক দিন এক দাড়িওয়ালা পুলিশ কনস্টেবলকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলেন। কেন ওই কনস্টেবল অত রাত পর্যন্ত থাকেন, সেই খোঁজ নিতে গিয়ে সুব্রত নাকি জানতে পারেন, সেই কনস্টেবল মহাকরণেই গলায় দড়ি দিয়ে আত্মঘাতী হয়েছিলেন! সে কথা জানামাত্রই মন্ত্রী সুব্রত তাঁর দৈনিক কর্মসূচি পাল্টে ফেলেন। খবরের কাগজগুলিতে তিনি জানিয়ে দেন, প্রকাশিতব্য রিপোর্ট রাতে তাঁর মহাকরণের দফতরে পাঠাতে হবে না। উল্টে তিনিই সমস্ত কাগজের দফতরে ঘুরে ঘুরে গিয়ে রিপোর্টগুলি দেখে নেবেন।

ভূতের ভয়ে সুব্রত সারা রাত ঘরের আলো জ্বালিয়ে ঘুমোতেন। সহধর্মিণীর আপত্তিও তাঁকে টলাতে পারেনি। রাজনৈতিক কর্মসূচি উপলক্ষে বাইরে গেলে রাতে একা ঘুমোতেন না। কাউকে না কাউকে সঙ্গে রাখতেন। প্রাক্তন বিরোধী দলনেতা কংগ্রেসের আব্দুল মান্নানের কথায়, “শুধু সুব্রতদা কেন, সোমেনদাও (প্রয়াত কংগ্রেস নেতা সোমেন মিত্র) ভূতের ভয় পেতেন। সুব্রতদার মুখেই শুনেছিলাম, জরুরি অবস্থার সময় রাত পর্যন্ত রাইটার্স বিল্ডিংয়ে কাজ করার সময় তিনি ভূত দেখেছিলেন। সেই থেকেই তাঁর ভূতে অসম্ভব ভয়।” মান্নান নিজে অবশ্য ২৫ বছর বিধায়ক থাকাকালীন কখনও বিধানসভা ভবনে ভূত দেখেননি। ভূত শুনতেও পাননি।

গবেষক হরিপদ ভৌমিকের মতে, ‘তেনাদের’ দেখা পাওয়ার জন্য বিশেষ এক ধরনের ‘পরিবেশ’ দরকার হয়। তাঁর আক্ষেপ, কল্লোলিনী কলকাতায় তেমন পরিবেশ প্রায় নেই। হরিপদ বলেন, ‘‘অনেক বছর আগে কলকাতার ভূত এবং ভূতুড়ে বাড়ি নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম। ভূতেদের থাকার জন্য এক ধরনের বিশেষ পরিবেশ দরকার। তাদের বসবাসের জন্য শ্যাওড়া গাছ, এঁদো পুকুর, আলো-আধাঁরি পরিবেশ লাগে। নগরসভ্যতার গ্রাসে কলকাতায় তেমন পরিবেশ আর নেই।’’ তবে পাশাপাশিই তাঁর স্বীকারোক্তি, ‘‘আমি নিজে কখনও ভূত দেখিনি।”

তা হলে বিধানসভা ভবনের দোতলায় ‘ভূতুড়ে’ শব্দ আর ‘অশরীরী’ অনুভূতির কী হবে? প্রাক্তন বিধায়ক নির্বেদ রায় ‘ভূত-টুত’ ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে বলছেন, ‘‘এ সব বোগাস!’’ আর রসিক বিরোধী রাজনীতিক বলছেন, ‘‘এ রাজ্যে ভূতও নেই। ভবিষ্যৎও নেই। এগুলো বোধহয় কারও কারও নাইট ডিউটি থেকে অব্যাহতি পাওয়ার ফন্দি।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement