বলরাম দে স্ট্রিট

পরিষেবা উন্নত হলেও বাড়েনি নাগরিক-সচেতনতা

অবিরাম কোলাহল, মানুষের অন্তহীন চলাচল আর যান যাতনার কর্কশ আর্তনাদ। তারই মাঝে নতুনের পাশে পুরনো বাড়ি, ক্ষীণ হয়ে আসা উত্তুরে বনেদিয়ানা আর প্রাদেশিকতার গ্রাসে আচ্ছন্ন আমাদের পুরনো পাড়া বলরাম দে স্ট্রিট।

Advertisement

গোপালচন্দ্র নাগ

শেষ আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০১৬ ০১:৪৮
Share:

অবিরাম কোলাহল, মানুষের অন্তহীন চলাচল আর যান যাতনার কর্কশ আর্তনাদ। তারই মাঝে নতুনের পাশে পুরনো বাড়ি, ক্ষীণ হয়ে আসা উত্তুরে বনেদিয়ানা আর প্রাদেশিকতার গ্রাসে আচ্ছন্ন আমাদের পুরনো পাড়া বলরাম দে স্ট্রিট।

Advertisement

গর্ব করে বলি জোড়াসাঁকোর ধার ঘেঁষা আমাদের পাড়া। এক দিকে, স্বামী বিবেকানন্দের স্মৃতিধন্য সিমলে অঞ্চল। অন্য দিকে, রবিঠাকুরের জোড়াসাঁকো, তারই মাঝখানে আমাদের পাড়ার অবস্থান। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ থেকে শুরু করে সোজা গিয়ে বাঁ দিকে ঘুরে পাড়াটা মিশেছে বিবেকানন্দ রোডে।

ভাবতে ভাল লাগে আজও আমাদের পাড়ায় বাড়ির সংখ্যাই বেশি। পাড়ার বাইরের চেহারাটা খুব একটা না বদলালেও, বেড়েছে বাড়িগুলির উচ্চতা, বদলেছে তাদের চেহারা। তবে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তৈরি হয়েছে কিছু বহুতল। কমছে বাঙালিদের সংখ্যা, পরিবর্তে আসছেন অবাঙালিরা। কমেছে মানুষে মানুষে যোগাযোগ, দেখাসাক্ষাৎ। তবে হারায়নি অন্তরের টান। পাড়ার পুরনো বাসিন্দাদের মধ্যে এখনও সেটা কিছুটা হলেও আছে। বিপদে আপদে তাঁরা এখনও একে অপরের পাশে দাঁড়ান। এক পাড়ায় থাকলেও নতুনদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই বললেই চলে। তাঁরাও নিজেদের মতো থাকতে পছন্দ করেন। এক এক সময় তো ভেবে অবাক হয়ে যাই যে এক পাড়ায় থেকেও অনেকে অপরিচিতই থেকে যান।

Advertisement

ছোটবেলায় ঘুম ভাঙতো পাখির ডাকে আর হোসপাইপ দিয়ে রাস্তা ধুইয়ে দেওয়ার শব্দে। এখন ঘুম ভাঙে অটো আর বাইকের হর্নে। তখন পাড়ার পাঁচ-ছ’টা বাড়িতে ভাল্ভ রেডিও থাকায় ভোর থেকেই পাড়াটা গমগম করত। সেই সময় রেওয়াজ ছিল বাড়িতে ভাল-মন্দ কিছু রান্না হলে তা প্রতিবেশীদের বাড়ি পাঠানোর। তাঁরাও ঠিক এমনটাই করতেন। আজ এ সব যেন গল্পকথা।

অনেক বদলেছে আমাদের পাড়া। সময়ের সঙ্গে অন্তরের শূন্যতা বাড়লেও বাইরের চেহারায় এসেছে পরিবর্তন। এখন নিয়ম করে জঞ্জাল সাফাই ও রাস্তা পরিষ্কার হয়। পর্যাপ্ত পানীয় জল ও জোরালো আলো উন্নত নাগরিক পরিষেবার ইঙ্গিত দেয়। তবে এ পাড়ার কিছু মানুষের মধ্যে রয়েছে নাগরিক সচেতনতার অভাব। প্রায়ই আছড়ে পড়ে প্লাস্টিক-বন্দি জঞ্জাল যা রাতের দিকে ভয়াবহ রূপ নেয়।

আছে কিছু সমস্যাও। যেমন পার্কিং। কাছাকাছি বড়বাজার এলাকা তাই অনেকেই পাড়ায় গাড়ি পার্ক করে অন্যত্র চলে যান। অনেক সময় বাড়ির সামনে অন্য গাড়ি থাকায় গাড়ি ঘোরানো যায় না। আগে রাস্তায় জল না জমলেও এখন বৃষ্টি হলেই কিছু কিছু জায়গায় জল জমছে। পাড়ার কিছু কিছু জায়গা মাকড়়সার জালের মতো কেবলের আর টেলিফোনের তারের জটে আবদ্ধ। তবে সমস্যা যতই থাক না কেন এ অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই উন্নত। আর পাড়াটা আজও শান্তিপূর্ণ।

আগে দোল বা বিজয়া দশমীর দিন পড়শিরা একে অপরের বাড়ি যাওয়ার পাশাপাশি চলত পেটপুজোও। বাড়িতে তৈরি মিষ্টি আর ঘুগনির সেই স্বাদ আজও মনে পড়ে। তবে ভোজন রসিকদের কাছে এ পাড়ার অন্য এক ঠিকানা নিরঞ্জন আগার। সন্ধ্যা হলেই ম-ম করা চপ, কাটলেট, ফ্রাইয়ের গন্ধে লোভ সংবরণ করা যথার্থই মুশকিল। গত পঞ্চাশ বছরেও‌ বদলায়নি তার পুরনো চেহারাটা। ঝাঁ চকচকে না হলেও সেই সাবেক চেয়ার টেবল আর সেই পরিচিত গন্ধ আজও জিভে জল এনে দেয়। সেই আকর্ষণেই তো দক্ষিণ হোক বা উত্তর ভিড় করেন খাদ্যরসিকেরা।

দৈনন্দিন জীবনে খেলাধুলোর ছবিটা এখানে কমই চোখে পড়ে, তবে বছরে কোনও কোনও সময় রাস্তায় ফুটবল টুর্নামেন্ট হয়। কাছেই গিরিশ পার্কে এলাকার প্রবীণরা সকাল-সন্ধ্যা বেড়াতে যান। এ পাড়ায় সর্বজনীন দুর্গাপুজো, কালীপুজো, জগদ্ধাত্রী পুজোর পাশাপাশি কিছু প্রাচীন পারিবারিক পুজো আজও সাবেক ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। যেমন, শ্যামলধন দত্তের বাড়ির দুর্গাপুজো। এ ছাড়াও খাঁ এবং কুণ্ডু পরিবারের অন্নপূর্ণা পুজো হয়। এ পাড়াতেই আছে ভট্টাচার্য পরিবারের প্রাচীন কালীমন্দির।

আগের তুলনায় আড্ডার পরিবেশ অনেকটাই কমেছে এখানে। তার কারণও আছে। আগের মতো দশটা-পাঁচটা অফিস করার দিন ফুরিয়েছে। বেশির ভাগ মানুষ এখন রাত করে বাড়ি ফেরেন। ইচ্ছে থাকলেও সময়ের অভাবে সেটা সম্ভব হয় না। এখন হাজারো সান্ধ্য বিনোদনের হাতছানি আর সময়ের অভাবে চিরদিনের আড্ডাটা বড় ম্লান হয়ে গিয়েছে।

পাড়ার কিছু অবসরপ্রাপ্ত মানুষের পরিচালনায় চলে সিমলা সেবা সমিতি। আজও বেশ কয়েক জন বিশিষ্ট চিকিৎসক বিনা পারিশ্রমিকে রোগী দেখেন। ভাবতে ভাল লাগে এতে এখনও কোনও রাজনৈতিক প্রভাব পড়েনি। নামমাত্র অর্থে হোমিওপ্যাথি ওষুধও দেওয়া হয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং দুঃস্থদের বস্ত্রদানও করা হয়।

সময়ের সঙ্গে বদলেছে নতুন বাজারটাও। ফল ও সব্জির জোগান ঠিক থাকলেও কমেছে মাছের জোগান। তাই এ অঞ্চলের বেশির ভাগ মানুষ ছাতুবাবুর বাজারে যান।

মাঝে মাঝে স্মৃতিমেদুর হয়ে যাই ছেলেবেলার পাড়ার কথা ভাবতে ভাবতে। সেই মানুষগুলো, বাড়িগুলো স্মৃতিগুলো আজও মনে উজ্জ্বল। তার তো বয়স বাড়েনি। ক্ষণিকের সেই সুখস্মৃতি যেন মুহূর্তেই চুরমার হয়ে যায় গাড়ির ব্রেক কষার আওয়াজে আর মানুষের কোলাহলে— এ পাড়ার বাস্তব সে যে বড়ই কঠিন।

লেখক প্রাক্তন সরকারিকর্মী

ছবি : সুমন বল্লভ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement