বাথরুমে পুড়ে মরলেন কঙ্কাল কাণ্ডের পার্থ

বছর দুয়েক আগে বাবা। এ বার ছেলে।২০১৫-র ১০ জুন। রবিনসন স্ট্রিটের একটি বাড়ির শৌচাগার থেকে উদ্ধার হয়েছিল ৭৭ বছরের এক ব্যক্তির অগ্নিদগ্ধ দেহ। সেই বাড়িতে গিয়ে পুলিশ জানতে পারে, মৃত ব্যক্তির ছেলে তাঁর দিদির কঙ্কালের সঙ্গে মাসের পর মাস ওই বাড়িতে রয়েছেন।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০২:৫৬
Share:

বছর দুয়েক আগে বাবা। এ বার ছেলে।

Advertisement

২০১৫-র ১০ জুন। রবিনসন স্ট্রিটের একটি বাড়ির শৌচাগার থেকে উদ্ধার হয়েছিল ৭৭ বছরের এক ব্যক্তির অগ্নিদগ্ধ দেহ। সেই বাড়িতে গিয়ে পুলিশ জানতে পারে, মৃত ব্যক্তির ছেলে তাঁর দিদির কঙ্কালের সঙ্গে মাসের পর মাস ওই বাড়িতে রয়েছেন। দিদির কঙ্কালকে খেতেও দিতেন ভাই— পার্থ দে। মঙ্গলবার খিদিরপুরের এক অভিজাত আবাসন থেকে রবিনসন স্ট্রিটের কঙ্কাল কাণ্ডে অভিযুক্ত সেই পার্থ দে (৪৬)-রই অগ্নিদগ্ধ দেহ উদ্ধার করা হয়েছে।

প্রাথমিক তদন্তে অনুমান, আত্মহত্যা করেছেন পার্থ। তিনি স্কিৎজোফ্রেনিয়ায় ভুগছিলেন। দু’বছর আগে পার্থর বাবা অরবিন্দও বাথরুমে গায়ে আগুন দিয়ে আত্মঘাতী হন।

Advertisement

পুলিশ জানিয়েছে, এ দিন বেলা ১২টা নাগাদ ফাদার রডনি নামে এক জন থানায় খবর দেন, নিজের ফ্ল্যাটের শৌচাগারের ভিতরে আটকে রয়েছেন পার্থ। সাড়া নেই। পুলিশ এসে পার্থর প্রাণহীন ঝলসানো দেহ উদ্ধার করে। পাশে পেট্রোলের বোতল, দেশলাই। কঙ্কাল কাণ্ডের পরে মানসিক হাসপাতালে ছিলেন পার্থ। তারপর তাঁকে পাঠানো হয় ‘মিশনারিজ অব চ্যারিটি’-র হোমে। সেখানকার ফাদার রডনিই পার্থর দেখভাল করতেন।

পুলিশ সূত্রের খবর, কাল, বৃহস্পতিবার নগর দায়রা আদালতে কঙ্কাল-কাণ্ডের চার্জ গঠন হওয়ার দিন নির্ধারিত হয়েছিল। চার্জ গঠনের পর ওই মামলার শুনানি শুরু হতো। তার দু’দিন আগেই একমাত্র অভিযুক্ত পার্থের মৃত্যুর ফলে শুনানি আর হবে না বলে জানান আইনজীবীরা। আদালতে তাঁর মৃত্যুর সার্টিফিকেট জমা দিলেই মামলা শেষ হয়ে যাবে।

বার করে আনা হচ্ছে পার্থর দগ্ধ দেহ।নিজস্ব চিত্র।

পুলিশ সূত্রের খবর, এ দিন শৌচাগারের ভিতরে উপুড় হয়ে পড়েছিলেন পার্থ। সবুজ টি-শার্ট, ছাই রঙের বারমুডা পরা। মাথার দিকটি এমন ভাবে হেলে ছিল, যে দরজা খোলা যাচ্ছিল না। অনেক চেষ্টার পরে দরজা খুলে দেখা যায়, পার্থ পড়ে আছেন। শরীরের উপরের অংশের চামড়া ঝলসানো। ঘর অগোছালো, খাটের ওপর বেশ কিছু বই ও দু’টি ল্যাপটপ। সারা ঘরে মাদার টেরিজার ছবি ও প্রচুর বই। প্রাথমিক তল্লাশিতে কোনও সুইসাইড নোট মেলেনি।

দু’বছর আগে কঙ্কাল-কাণ্ডে কী অভিযোগ ছিল পার্থর বিরুদ্ধে?

পুলিশ জানিয়েছে, পার্থ তাঁর দিদি দেবযানী দে-র মৃত্যুর কথা গোপন করেছিলেন। দিদির মৃতদেহ ছ’মাস ঘরে রেখে দিয়েছিলেন। যা থেকে তল্লাটে রোগ ছড়ানোর আশঙ্কা ছিল।

এ দিন ৩ নম্বর রবিনসন স্ট্রিটের সেই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মূল ফটকের বাইরে তালা। ভিতরে এক নিরাপত্তারক্ষী। অশোক যাদব নামে ওই নিরাপত্তারক্ষী জানান, মাস সাতেক আগে প্রোমোটারের কাছে বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছে দে পরিবার। কার কাছে, তা জানেন না। এখনও দু’টি ভাড়াটে পরিবার ওই বাড়িতে থাকে বলে জানান এলাকাবাসী।

আরও পড়ুন: অবসাদ, না কি আত্মগ্লানি, প্রশ্নে পার্থর আত্মহত্যা

সূত্রের খবর, কঙ্কাল-কাণ্ডের পর থেকে পাভলভে ২০১৫-র সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চিকিৎসা চলে পার্থর। তার পর দক্ষিণ ২৪ পরগনায়, ‘মিশনারিজ অব চ্যারিটি’-র একটি হোমে ছিলেন। ফাদার রডনিই খিদিরপুরে ওই ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা করে দেন। রবিনসন স্ট্রিটের বাড়ি বিক্রির টাকায় ফ্ল্যাটটি কেনা হয়েছিল বলে জেনেছে পুলিশ। গত বছরের মার্চ মাস থেকে খিদিরপুরে থাকতে শুরু করেন পার্থ। সঙ্গে থাকতেন প্রদীপ সরকার নামের বছর পঁয়তাল্লিশের এক পরিচারক।

প্রদীপ জানান, রোজকার মতোই এ দিন সকাল ন’টায় পার্থর ফ্ল্যাটে যান তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘স্যারের পেটটা ভাল ছিল না। নুন-চিনির জল করে দিই। তার পর একটা কাজে আমায় যাদবপুরে পাঠান স্যার। সাড়ে ১১টায় ফিরে দেখি, ঘরের মূল দরজা ভেজানো। বাথরুম ভেতর থেকে বন্ধ, সাড়া মিলছে না। সঙ্গে সঙ্গে খবর দিই ফাদার রডনিকে।’’

ফাদার রডনি বলেন, ‘‘পার্থ আমার ভাইয়ের মতো। নিয়মিত ওর খেয়াল রাখতাম। কয়েক মাস অন্তর মনোবিদের কাছেও নিয়ে যেতাম। জানি না, কেন এমন করল ও।’’

খিদিরপুরে পার্থের প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, ওখানে যাওয়ার পর থেকেই তাঁকে ঘিরে কৌতূহল ছিল সকলের। কেউ কেউ ভয়ও পেয়েছিলেন। কিন্তু পার্থকে নিয়ে কারও কোনও সমস্যা হয়নি। বরং অন্তর্মুখী বলেই পরিচিত ছিলেন আবাসনে। কারও সামনাসামনি হলে মুখ নিচু করে ফেলতেন। জানা গিয়েছে, আত্মজীবনী লেখা শুরু করেছিলেন পার্থ।

ওই আবাসনের ১২তলার যে ফ্ল্যাটে পার্থ থাকতেন, তার ঠিক পাশের ফ্ল্যাটের শাকিল আনোয়ার জানালেন, পার্থ মাঝেমধ্যেই গাড়ি করে বেরোতেন, সঙ্গে থাকতেন প্রদীপ। আবাসনের ‘ফেসিলিটি ম্যানেজার’ লক্ষ্মণ ঘোষ জানান, প্রতিদিন আবাসন চত্বরেই প্রাতর্ভ্রমণ করতেন পার্থ। কারও সঙ্গে কোনও কথা বলতেন না। কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’-এ উত্তর দিতেন। গত এক সপ্তাহ অবশ্য প্রাতর্ভ্রমণে বেরোতে দেখা যায়নি ওঁকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন