দেশসেবার টানেই পূর্ণ শরবতি উৎকর্ষ

নিজের ঢাক নিজে পিটিয়ে বিজ্ঞাপনের ‘তারল্য’ এখনও চরম অশ্লীলতা এ তল্লাটে। তবে শরবতের দোকানের হলুদ বোর্ডখানাই যা বলার বলছে।

Advertisement

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৮ ০৩:১৯
Share:

নিজের ঢাক নিজে পিটিয়ে বিজ্ঞাপনের ‘তারল্য’ এখনও চরম অশ্লীলতা এ তল্লাটে। তবে শরবতের দোকানের হলুদ বোর্ডখানাই যা বলার বলছে।

Advertisement

আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র, নেতাজি সুভাষ, মেঘনাদ সাহা, জগদীশচন্দ্র বসু, সত্যেন বসু, নজরুল, মানবেন্দ্রনাথ রায় থেকে স্বদেশি যুগের একরোখা বিপ্লবীদের নাম লেখা তাতে। রয়েছেন শচীন কত্তা-ফৈয়াজ খান-উদয়শঙ্কর-উত্তম-সুচিত্রারাও। তাঁদের সবার স্পর্শ মিশে আছে কলেজ স্ট্রিটে দিঘির পাশের সেই আয়তক্ষেত্রাকার পরিসরে। সাবেক জাতীয়তাবাদী বাঙালির অহঙ্কার ও সাংস্কৃতিক শৌর্যের নামাবলী একাকার তরল-তীর্থ ‘প্যারামাউন্ট’-এর ব্র্যান্ড-গরিমার সঙ্গে। বইপাড়ায় সেই আবহমান তৃষ্ণার শান্তি দেখতে দেখতে শতক ছুঁয়ে ফেলল।

একটু উত্তরে এগোলে শ্রীমানি মার্কেটের কপিলাশ্রমের বয়সও বেশি বই কম নয়। ভাঙাচোরা দেওয়ালের খোপে হতশ্রী, জরাজীর্ণ চেহারা। বাঙালির ঘরে ঘরে চেনা দুধ-দইয়ের ঘোলের শরবত নিয়ে সৃষ্টিশীলতার কারবার যেন ঠিক মুনাফাখোর ব্যবসাবৃত্তি নয়। তেষ্টা মিটিয়ে সেবার ভাবটাই প্রধান। বছর দশেক আগে কপিলাশ্রমের তৎকালীন কর্তাকে ছবি তুলতে রাজি করাতেও কালঘাম ছুটেছিল। বিজ্ঞাপন দূরে থাক, মিডিয়ায় কথা বলাও তাঁর কাছে অধর্মের শামিল! আত্মপ্রচারময় ইনস্টাগ্রাম-ফেসবুকের জমানায় সে যুগের অভিজ্ঞান পড়তে পারা মুশকিল! সুখের কথা, ইদানীং তাঁরা খানিক নমনীয় হয়েছেন।

Advertisement

তবু নরম পানীয়ের খাও-পিয়ো-জিয়ো সংস্কৃতির সঙ্গে প্যারামাউন্ট বা কপিলাশ্রমের মূল্যবোধে ঢের ফারাক। চা-পানে ঘোর বিতৃষ্ণা ছিল আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের। পরাধীন দেশের ছেলেছোকরাদের স্বাস্থ্য রক্ষায় পেট ভরানো, স্বাদু, ‘ফুড ভ্যালু’ ঠাসা শরবতের পরামর্শ তিনিই দিয়েছিলেন প্যারামাউন্টের প্রাণপুরুষ নীহাররঞ্জন মজুমদারকে। তাঁদের ধ্রুপদী ডাবের শাঁস ভরপুর সরবতের এটাই জন্ম-কাহিনি। শাঁসে পেট ভরবে, ডাবের জলে বুক জুড়োবে। এই শরবতেই অন্য মাত্রা জুড়তে কিছু বিদেশি এসেন্সের তুকতাক শিখিয়ে দিলেন প্রফুল্লচন্দ্র। প্যারামাউন্টের কর্তারা সেই রেসিপি গোপনে আগলে রেখেছেন।

বরিশালের বিপ্লবী, তরুণ সতীন সেনের সঙ্গে পকেটে চারটি পয়সা নিয়ে শিয়ালদহে নেমেছিলেন নীহাররঞ্জন। দিঘির পিছনের বাড়িটায় বরিশালের অনুশীলন সমিতির তরুণদের আড্ডা। তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েই শরবতের দোকান চালু হল। স্বদেশি আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে নীহাররঞ্জন তখন হামিদা পালোয়ানের আখড়ায় কুস্তি শিখছেন। পুলিনবিহারী দাসের কাছে লাঠিখেলায় দীক্ষা। শারীরচর্চা, স্বদেশপ্রেমের সঙ্গে শরবত-সেবাও মূল্যবোধের আর এক নাম হয়ে উঠল। গোড়ায় নাম ছিল প্যারাডাইস। প্যারামাউন্ট নামটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের। কলেজ স্ট্রিটের মেসবাসী গরিব ছাত্র, প্রেসিডেন্সি-কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী মুখ থেকে লাহাবাড়ি, মল্লিকবাড়ি, ভাগ্যকুলের রাজপরিবারের অভিজাতজনকে যা এক ঘাটে মিলিয়ে দিয়েছিল।

সাবেক কলকাতার এই শরবতি সংস্কৃতিতে জাতীয়তাবাদ মিশে থাকলেও দুনিয়াকে আপন করার খোলা মনটা কিন্তু ছিল। জাল-পাতা আসনের যে কাঠের চেয়ারে বসতেন সুভাষচন্দ্র, তার সামনে ইতালিয়ান মার্বেল টপের দুধসাদা টেবিল। নীহারবাবুর ছোট ছেলে, প্যারামাউন্টের এখনকার কর্তা মৃগেন্দ্র আফশোস করেন, ম্যাগনোলিয়া, চন্দনের মতো কী দুরন্ত এসেন্স মিলত সে যুগে। ষাটের দশকে সন্ধ্যা রায়ের বিয়ের নেমন্তন্নে সেই চন্দনের এসেন্স একটু জামায় ছিটিয়েই নাকি গিয়েছিলেন মৃগেনবাবু। সুগন্ধ ভুরভুর করছিল। বিশ্বায়ন-পরবর্তী জমানাতেও সে সব এসেন্স জোগাড় করা ভারী শক্ত! তবে সৃষ্টিশীলতায় ছেদ নেই। আদি যুগের ডাব বা কমলা-আনারস-ভ্যানিলা ফ্লেভারের সঙ্গে সম্প্রতি ‘প্যাশন ফ্রুট’ বা মালাই-আরোপিত পাকা আমের ‘ম্যাঙ্গো ম্যানিয়া’ সৃষ্টিতেও মৃগেনবাবু মাথা খাটিয়েছেন।

কপিলাশ্রমে ভ্যারাইটি কম। আমের শরবত, কেশর মালাই, রোজ মালাই হয় ধাপে ধাপে। কফি পার্লারের যুগে রোদে লাইন দিয়ে শরবত কেনায় তত সায় নেই কলকাতার। তবু খানদানি মেজাজটুকু অটুট। প্যারামাউন্টে অবশ্য ভিড় লেগেই আছে। সেখানে এখ নও মিক্সির প্রবেশ নিষেধ। মন্থন দণ্ড বা শরবতের কাঁটার ম্যাজিক অনায়াসে কলকাতাকে তার গত জন্মে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

উৎকর্ষের সাধনাই সে দিনের বাঙালির ব্যবসার মন্ত্র ছিল। আর দেশ ও তার মানুষের প্রতি ভালবাসার টানেই জন্ম নিত উৎকর্ষের তাগিদ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন